জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ছয়জন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আনুষ্ঠানিক অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এই কর্মকর্তারা করদাতা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে কর, ভ্যাট ও শুল্ক ফাঁকির সুযোগ করে দিয়ে নিজেরা আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন জানায় দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি।
বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবার (০১ জুলাই) সকাল ১১টায় দুদকের প্রধান কার্যালয়, সেগুনবাগিচায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন।
তিনি বলেন, ‘অভিযুক্ত কর্মকর্তারা দীর্ঘ ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে বিভিন্ন স্টেশনে চাকরিরত অবস্থায় করদাতা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে কর, ভ্যাট এবং শুল্ক ফাঁকির সুযোগ দিয়ে নিজেরা আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। এর ফলে রাষ্ট্রের রাজস্ব খাতে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে।’
দুদকের অনুসন্ধানের আওতায় যেসব কর্মকর্তা আছেন তারা হলেন—আয়কর নীতি বিভাগের সদস্য এ কে এম বদিউল আলম, নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের অতিরিক্ত কমিশনার হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার, ঢাকা-৮ কর অঞ্চলের অতিরিক্ত কমিশনার মির্জা আশিক রানা, ঢাকা কর অঞ্চল-১৬ এর অতিরিক্ত কমিশনার মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা, ঢাকা দক্ষিণ কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের অতিরিক্ত কমিশনার সাধন কুমার কণ্ডু এবং বিএসএস কর একাডেমির যুগ্ম কর কমিশনার মোহাম্মদ মোরশেদ উদ্দীন খান।
দুদকের তথ্য মতে, এই ছয়জন কর্মকর্তার মধ্যে অন্তত পাঁচজন এনবিআরের চলমান সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এর মধ্যে হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’-এর সভাপতি, আর মির্জা আশিক রানা ও মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
বিজ্ঞাপন
অনুসন্ধানের তালিকায় এনবিআর সংস্কার আন্দোলনের নেতাদের নাম থাকায় বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে—দুদকের এ পদক্ষেপ কি আন্দোলন দমন করার একটি কৌশল?
এই প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বলেন, ‘দুদকের অনুসন্ধান কেবলমাত্র প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে। এটি কোনওভাবেই এনবিআরের চলমান আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় নয়। আমাদের দায়িত্ব, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তা যাচাই-বাছাই করা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তদন্ত চালানো।’

তিনি জানান, কমিশনের কাছে একাধিক অভিযোগ জমা পড়ে, যেখানে কর ফাঁকিতে সহায়তা, ঘুষ গ্রহণ এবং অপ্রদর্শিত সম্পদ অর্জনের সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে।
আক্তার হোসেন আরও বলেন, ‘এই ছয়জন ছাড়াও কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে কমিশন অবশ্যই তা বিবেচনায় নেবে।’
দুদক বলছে, যেসব অভিযোগ এসেছে, তা শুধু ঘুষ গ্রহণেই সীমাবদ্ধ নয়। কর ফাঁকি দিতে করদাতাদের সহায়তা, আবার ঘুষ না দিলে হয়রানির মাধ্যমে মিথ্যা মামলা—এমন চিত্রও উঠে এসেছে।
দুদকের মতে, এসব কর্মকর্তার কেউ কেউ করদাতার প্রকৃত আয় কম দেখিয়ে কর নির্ধারণে সহায়তা করেছেন, আবার কেউ আবার ‘ঘুষ না দেওয়ায়’ হেনস্তার পথে গিয়েছেন।
আক্তার হোসেন বলেন, ‘অনেক করদাতা অভিযোগ করেছেন—প্রকৃত করের চেয়ে অতিরিক্ত কর পরিশোধ করার পর নিয়ম অনুযায়ী টাকা ফেরত পাওয়ার কথা থাকলেও সেটির জন্য আবার ঘুষ দিতে হয়েছে। অভিযোগ আছে, কেউ কেউ ওই ফেরতের টাকার একাংশ নিজেরা নিয়ে নেন।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এসব কর্মকর্তা করদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃত হয়রানিমূলক তদন্ত করেছেন, আবার ঘুষ পেলে এসব প্রতিষ্ঠানের কর ফাঁকির অভিযোগ ফাইলবন্দি করে রেখেছেন। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কেটে নেওয়া হয়েছে, ফেরত দেওয়ার অজুহাতে।
এনবিআরের ভেতরে অনেক দিন ধরেই সংস্কারের দাবি উঠেছে। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম গঠিত হয়, যেখানে হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদারসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
তাদের অভিযোগ, এনবিআর রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত ও আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সেই সংস্কার আন্দোলনের মুখ্য নেতাদের একাংশ এখন দুদকের অনুসন্ধানে—তাতে অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছে।
তবে দুদক স্পষ্ট বলেছে—আন্দোলনের সঙ্গে অনুসন্ধানের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত যাচাই করেই অনুসন্ধান শুরু করা হয়েছে।
দুদক সূত্র বলছে, এই অনুসন্ধান শেষে প্রমাণিত হলে তদন্ত শুরু হবে। তদন্তে অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হবে।
তদন্ত প্রক্রিয়ায় এনবিআরের সংশ্লিষ্ট রেকর্ড, ব্যাংক লেনদেন, সম্পত্তির হিসাব এবং আয়কর রিটার্নসহ বিভিন্ন দপ্তরের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে দুদক সূত্র।
এমআই/ইএ