শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা কতদূর?

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ১৯ জুন ২০২২, ১১:১৩ পিএম

শেয়ার করুন:

দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা কতদূর?
ফাইল ছবি

বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে বিশ্ব। আগামী ২০ বছরের মধ্যে চাহিদার ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎই নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সম্পদশালী দেশগুলো। একই লক্ষ্যে বাংলাদেশেও নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। প্রণয়ন করা হয়েছে ‘ন্যাশনাল সোলার এনার্জি রোডম্যাপ ২০২১-২০৪১’।

টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির মূলে রয়েছে- পানি বিদ্যুৎ, সোলার পিভি ব্যবহার করে সৌর বিদ্যুৎ, বায়ু বিদ্যুৎ, পৌর বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ, গোবর ও পোল্ট্রি বর্জ্য ব্যবহার করে বায়োগ্যাস, বাতাসের গতি, ধানের তুস এবং ইক্ষুর ছোবড়া, বর্জ্য, শিল্প প্রক্রিয়ার অব্যবহৃত তাপ থেকে বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি উৎপাদন।


বিজ্ঞাপন


নবায়নযোগ্য এসব জ্বালানি উৎসের মধ্যে সৌরশক্তি সবচেয়ে সম্ভাবনাময় এবং বায়োগ্যাস ও বায়োমাসের রয়েছে সীমিত ব্যবহার। বর্তমানে দেশে প্রতিদিন গড়ে ৪ দশমিক ৫ কিলোওয়াট আওয়ার/বর্গমিটার সৌর বিকিরণ লাভ করে। তবে বায়ু বিদ্যুতের জন্য সম্ভাবনা এখনো গবেষণাধীন। এ জন্য ১৩টি স্থান থেকে বাতাসের উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে।

Power & Energy

২০২১ সালের মধ্যে দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে মোট বিদ্যুতের ১০ শতাংশ যোগ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ থাকলেও তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। আর ২০১৬ সালের সংশোধিত পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান (পিএসএমপি) অনুযায়ী, এই পাঁচ বছরে এখন পর্যন্ত ৭৭৭ দশমিক ২৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে, যা মোট বিদ্যুতের ৩ শতাংশ। এর মধ্যে ৪২৬ দশমিক ৭২ মেগাওয়াট জাতীয় গ্রিডে যোগ হচ্ছে। বিশাল এই নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে পাওয়া মোট বিদ্যুতের মধ্যে সৌর উৎস থেকে ৫৪৩ দশমিক ২৫ মেগাওয়াট, বায়ু থেকে ২ দশমিক ৯ মেগাওয়াট, হাইড্রো থেকে ২৩০ মেগাওয়াট, বায়োগ্যাস থেকে শূন্য দশমিক ৬৯ মেগাওয়াট এবং বায়োমাস থেকে শূন্য দশমিক ৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে।

তবে স্বল্প পরিসরে হলেও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রয়েছে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। ১৯৫৭ সালে চট্টগ্রামের কাপ্তাইয়ে কর্ণফুলী নদীর ওপর দেশের প্রথম পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে এই অভিজ্ঞতার শুরু হয়। পরে ১৯৮৮ সালের অক্টোবর মাসে এই কেন্দ্রে ৫০ মেগাওয়াট কাপলান টাইপের টার্বাইন সম্বলিত চতুর্থ এবং পঞ্চম ইউনিট স্থাপন করা হয়, যাতে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ২৩০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। এছাড়া আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে সিলেটে প্রথম সোলার হোম সিস্টেম স্থাপনে বেসরকারি উদ্যোগ সহায়ক ভূমিকা পালন করে।


বিজ্ঞাপন


পরবর্তীতে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল) কর্তৃক সোলার হোম সিস্টেম (এসএইচএস) কর্মসূচী ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়। ১৯৯৬ সালে এসএইচএস চালু হওয়ার পর থেকে এটি বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নবায়নযোগ্য জ্বালানি কর্মসূচী। সবমিলিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬ মিলিয়ন সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইডকলে’র মাধ্যমে সরকার কর্তৃক গৃহীত সমন্বিত কর্মসূচীর কারণে এর সংখ্যা আরও বাড়ছে। সেই সঙ্গে সোলার হোম সিস্টেম একটি বিশাল এবং বিশ্বস্ত সিস্টেম হওয়ায় এর সফলতার জন্য অনন্য গ্রামীণ ক্রেডিট এবং ‘কস্ট বাই ডাউন’ সিস্টেমের মাধ্যমে গ্রামীণ বাড়িগুলোও এর আওতায় এসেছে।

Power & Energy

ইতোমধ্যেই নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী এবং বিনিয়োগকারীদের সরকার বিভিন্ন প্রকার প্রণোদনা প্রদান করছে। সেই সঙ্গে সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন: বাংলাদেশ ব্যাংক, ইডকল এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থায়ন কার্যক্রমও সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এছাড়া কিছু নবায়নযোগ্য জ্বালানি পণ্য যেমন: সোলার প্যানেল, সোলার প্যানেল প্রস্তুতের উপাদান, চার্জ কন্ট্রোলার, ইনভার্টার, এলইডি লাইট, সৌরচালিত বাতি এবং বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর সরকার শুল্ক অব্যাহতিমূলক প্রণোদনাও দিয়েছে।

ফলে সোলার হোম সিস্টেমের সার্বিক সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে সরকারি কয়েকটি কর্মসূচী যেমন: সৌর সেচ, সৌর মিনি/মাইক্রো গ্রিড, সোলার পার্ক, সোলার রুফটপ, সোলার বোটিং ইত্যাদি শুরু হয়েছে। আর নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্যতম লক্ষ্যই হলো গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা এবং ডিজেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো। যার ফলে কমবে কার্বন নিঃসরণ এবং সরকারি ভর্তুকি।

এতকিছু ছাড়াও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে সরকারের রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। ২০৫০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায় সরকার। এই লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই ন্যাশনাল সোলার রোডম্যাপ, ২০২১-২০৪১ প্রণয়ন করা হয়েছে। পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালায় ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী- নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে স্রেডা-ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কার্যক্রমের পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন, তদারকিকরণ, বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় সাধন, সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিতকরণের মতো কার্যক্রমগুলো চালিয়ে যাচ্ছে।

Power & Energy

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বছরভিত্তিক পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে। সেই সঙ্গে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্পদ মূল্যায়ন ও নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য রোডম্যাপ, ২০৩০ অনুসারে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। পাশাপাশি সৌর-বিদ্যুতের জন্য খসড়া রোডম্যাপ, ২০৪১ নিয়েও পর্যালোচনা চলছে।

সম্প্রতি এ বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে নসরুল হামিদ বলেছেন, জাতীয় সৌর বিদ্যুৎ রোডম্যাপ, ২০২১-৪১ এর খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। সমন্বিত বিদ্যুৎ জ্বালানি মাস্টারপ্ল্যানে ক্লিন এনার্জিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এতে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন উৎসে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২৯টি কোম্পানি আগ্রহ প্রকাশ করেছে। যা অফসোর উইন্ড, গ্রিন হাইড্রোজেন, ভাসমান সোলার, বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ, সোলার রুফটপ ইত্যাদি খাতে বিনিয়োগ নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারে নতুন মাত্রা যোগ করবে।

বিষয়টিতে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ঢাকা মেইলকে বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি হচ্ছে বিশ্বের ভবিষ্যৎ। বাংলাদেশের জন্যও তা জরুরি। ভবিষ্যতে যেটা আমাদের জন্য সবদিক থেকে উপকারী, সবচাইতে সুলভ, সবচেয়ে নিরাপদ- সেই জ্বালানিতে সরকারের তেমন মনোযোগ নেই। এ বিষয়ে খুব বেশি গুরুত্বও নেই তাদের। সরকার অনেক সময় বলে, ২০৪০ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি বাস্তবায়ন করবে- বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা-ফোরাম আছে, সেসবের জন্য এসব কথাবার্তা বলা হয়। বাস্তবে সরকার কয়লা-পারমানবিকের দিকেই আগ্রহী বেশি। এটার পেছনে কোনো যৌক্তিকতা নেই।

এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, যখন সারা বিশ্বে কয়লাভিত্তিক জ্বালানি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে সবাই মনোযোগ দিচ্ছে, তখন বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানিটা একটা সাইনবোর্ড হিসেবে রাখছে। বাস্তবে সেগুলার কোনো কার্যকারিতা নেই। সরকার ঝুঁকছে কয়লা ও পারমানবিক বিদ্যুতের দিকে। এটা সবার জন্য খুব ঝুঁকিপূর্ণ এবং আর্থিকভাবেও খুব ব্যয়বহুল।

টিএই/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর