সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ঈদুল আজহায় অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য

মহিউদ্দিন রাব্বানি
প্রকাশিত: ০৬ জুন ২০২৫, ০৪:৪৩ পিএম

শেয়ার করুন:

Eid_ul_Adha
প্রতিবছর গ্রাম থেকে হাজার-হাজার গরু বিক্রির জন্য শহরাঞ্চলে আনা হয়।

প্রতি বছর কোরবানির ঈদ তথা ঈদুল আজহা উপলক্ষে দেশের অর্থনীতিতে এক বিশাল প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। এই ঈদকে ঘিরে কোরবানির পশু কেনাবেচা, চামড়া শিল্প, পরিবহন, কসাই সেবা, পশুর খাদ্য, লবণ, বাঁশ-চাটাই, দা-বটি, পশুর সাজসজ্জা, হাট ইজারা, কোরবানির মাংস পরিবহনসহ আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক নানা খাতে আর্থিক লেনদেন ও মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোরবানি হলো বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক তৎপরতা, যা আমাদের জাতীয় অর্থনীতির চাকায় আরও গতি সঞ্চার করে। সব মিলিয়ে এক বিরাট অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে কোরবানিকেন্দ্রিক অর্থনীতির প্রভাব। দেশের অর্থনীতিতে কোরবানির অবদান অনস্বীকার্য। এ মহা কর্মযজ্ঞ কেন্দ্র করে লাখো-কোটি মানুষের অস্থায়ী কর্মসংস্থান এবং আয়-রোজগারের ব্যবস্থা সৃষ্টি হয়। এর মাধ্যমে দেশের জিডিপিও সমৃদ্ধ হয়।


বিজ্ঞাপন


494838107_736585628712359_4410631543790417570_n
কোরবানি উপলক্ষ্যে নানান ধরনের ব্যবসা বাণিজ্য শুরু হয়, যা প্রভাব রাখে স্থানীয় অর্থনীতিতে।

প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও প্রাণিসম্পদ অধিদফতর, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় দেশে কোরবানিযোগ্য গবাদি পশুর সংখ্যা নিরূপণ করেছে। এ বছর কোরবানিযোগ্য মোট ১ কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৭টি গবাদি পশুর প্রাপ্যতা আশা করা যাচ্ছে। এবার হৃষ্টপুষ্টকৃত গবাদি পশুর মধ্যে ৫৬ লাখ ২ হাজার ৯০৫টি গরু-মহিষ, ৬৮ লাখ ৩৮ হাজার ৯২০টি ছাগল-ভেড়া এবং ৫ হাজার ৫১২টি অন্যান্য প্রজাতি রয়েছে।

তবে, অন্যান্য বছরের ন্যায় এ বছরও প্রায় ২০ লাখ ৬৮ হাজার ১৩৫টি গবাদি পশুর উদ্বৃত্ত থাকবে বলে আশা করছে মন্ত্রণালয়। গত বছর দেশে কোরবানিযোগ্য পশু ছিল ১ কোটি ২৯ লাখ; এর মধ্যে কোরবানি হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ। ২০২৪ সালে শুধু কোরবানির পশু ক্রয়-বিক্রয় উপলক্ষে লেনদেন হয় ৬৯ হাজার ১৪১ কোটি ১২ লাখ টাকা, যার সিংহভাগই যুক্ত হয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে। এছাড়া গত বছর অনলাইন প্লাটফরমে ৪ হাজার ৭৪০ কোটি ৩৭ লাখ টাকা মূল্যের ৫ লাখ ৫ হাজার গবাদি পশু বিক্রি হয়েছে।

প্রবাসী আয়ের পালে হাওয়া


বিজ্ঞাপন


বাংলাদেশে কোরবানির ঈদের অর্থনীতি এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছে। এই সময়ে প্রবাসী আয়ও দেশে বেশি আসে। আর কোরবানির গরুর উৎপাদন মূলত গ্রামকেন্দ্রিক। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা করতেও কোরবানির ঈদ বড় ভূমিকা রাখে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

এদিকে কুরবানি ঈদের আগে দেশের অর্থনীতিতে স্বস্তির বার্তা নিয়ে এসেছে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। মাত্র তিন দিনে ৬০ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১২৩ টাকা ধরে) যার পরিমাণ দাঁড়ায় সাত হাজার ৪২৯ কোটি টাকার বেশি।

Eid_Ul_Adha
ঈদুল আজহা উপলক্ষে প্রবাসী আয়ের পালে হাওয়া

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি জুন মাসের প্রথম তিন দিনে (১-৩ জুন) রেমিট্যান্স এসেছে ৬০ কোটি ৪০ লাখ ডলার। বড় অঙ্কের এ রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং ঈদের বাজারকে করেছে চাঙা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ঈদুল আজহা সামনে রেখে সাধারণত গরু, ছাগল ও অন্যান্য কোরবানির পশু কেনা, নতুন পোশাক, উপহার এবং পারিবারিক ব্যয়ের জন্য প্রবাসীরা দেশে বেশি বেশি অর্থ পাঠান। এ সময় রেমিট্যান্স প্রবাহে সাধারণত ঊর্ধ্বগতি দেখা যায় এবং এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

সদ্য সমাপ্ত মে মাসে দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বাধিক রেমিট্যান্স এসেছে। যার পরিমাণ ২৯৭ কোটি বা ২.৯৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১২২ টাকা হিসাবে) যার পরিমাণ ৩৬ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রতি মাসেই দুই বিলিয়ন ছাড়াচ্ছে রেমিট্যান্স। 

চামড়া শিল্পে বিপুল সম্ভাবনা

চামড়া শিল্প ঈদুল আজহার অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। দেশের চামড়া শিল্পের চাহিদার সিংহভাগ জোগান আসে কোরবানির গবাদি পশুর চামড়া থেকে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম খাত চামড়া ও চামড়াজাত শিল্প। কোরবানির গবাদি পশুর চামড়া মানিব্যাগ, ব্যাগ, পাদুকাসহ অন্যান্য চামড়াজাত সামগ্রী প্রস্তুতিতে ব্যবহারযোগ্য চামড়ায় রূপান্তর করার জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়াকরণ ধাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, যেখানে ট্যানারিগুলোয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মৌসুমি কর্মসংস্থান হয়।

Screenshot_2025-06-06_164839

সম্প্রতি পবিত্র ঈদুল আজহা সামনে রেখে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। এ বছর ঢাকায় গরুর লবণযুক্ত চামড়ার প্রতি বর্গফুটের দাম গত বছরের তুলনায় ৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে।

এ বছর ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। অন্যদিকে ঢাকার বাইরে গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ), লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, চামড়াজাত পণ্য রফতানি খাতে দেশের আয় প্রতিবছরই ৯০ থেকে ১১০ কোটি ডলারের মধ্যে ওঠানামা করে।

নগরজীবনে ভোগ্যপণ্যের বেচাকেনা

ঈদকেন্দ্রিক কেনাকাটায় নগরভিত্তিক অর্থনীতিতে বিশাল চাঞ্চল্য তৈরি হয়। ফ্যাশন হাউজ, সুপারশপ, রেস্টুরেন্ট, প্রসাধন সামগ্রী, অনলাইন মার্কেটপ্লেস ও হোম ডেলিভারি -সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো কয়েকগুণ বেশি বিক্রি করে।

টেকনোডার্ট কনসালটিং- এর এক জরিপে বলা হয়েছে, ঢাকার মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো ঈদের সময় গড়ে ১৫-২৫ হাজার টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করে, যার ৪০ শতাংশ যায় খাদ্য, ৩০ শতাংশ পোশাক এবং বাকি অংশ উপহার, বাসনপত্র ইত্যাদিতে ব্যয় হয়।

গ্রামীণ অর্থনীতিতে কোরবানির প্রভাব

নানা দিক থেকে বিবেচনা করলে এখন কোরবানি ঈদে অর্থনীতির আকর এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে কোরবানির প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে গৃহস্থ, ছোট ছোট কৃষক চার-পাঁচটি গরু লালন-পালন করে কোরবানির বাজারে বিক্রি করে। এখান থেকে বছরে সে ভালো পরিমাণ অর্থ আয় করে; যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করছে। এছাড়া নাড়ীর টানে শহর থেকে ৫০ থেকে ৭০ লাখ মানুষ গ্রামে পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে যাচ্ছে। এতে চাঙা হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি।

মোবাইল ব্যাংকিংয়ে বিপুল লেনদেন

বিকাশ, নগদ, রকেটসহ মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসে ঈদ সামনে রেখে কয়েক গুণ লেনদেন বেড়ে যায়। গত বছর ঈদের আগের সপ্তাহে দৈনিক গড় লেনদেন ছিল ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। 

মসলার ব্যবসা

কোরবানির পশুর মাংস আমিষ জাতীয় খাদ্যের উপাদান। এটি রান্না করতে প্রায়োজন হয় পর্যাপ্ত নানা মসলা দ্রব্যের। শুধু কোরবানি উপলক্ষে এ ক্ষেত্রে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার মসলার ব্যবসা হয়ে থাকে বলে জানা গেছে।

দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৫ লাখ টন, রসুনের ৬ লাখ টন ও আদা ৪ লাখ টন। এর উল্লেখযোগ্য অংশই কোরবানিতে ব্যবহার হয়। গরম মসলা বিশেষ করে এলাচি, দারুচিনি, লবঙ্গ, জিরা, তেজপাতারও উল্লেখযোগ্য অংশ কোরবানিতে ব্যবহার হয়।

BAZAR_-1024x509

ঈদুল আজহা উপলক্ষে অর্থনীতিতে এই বিপুল আর্থিক কর্মকাণ্ড দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির গতিময়তা ধরে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে ধারণা অর্থনীতিবিদদের।

এদিকে ঈদ উপলক্ষে অর্থনীতির গতি বাড়লেও টেকসই অর্থনীতির জন্য কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগমুখী কিছু উদ্যোগ প্রয়োজন বলে জানান বিশ্বব্যাংক ঢাকার সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ঈদ ঘিরে মানুষ কেনাকাটা করেছেন। যার ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতেও গতির সঞ্চার ঘটবে। তবে আমাদের এখন কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগমুখী কিছু উদ্যোগ প্রয়োজন। সেটা যত তাড়াতাড়ি করা যাবে অর্থনীতিও তত তাড়াতাড়ি স্থিতিশীলতা ফিরে পাবে বলে তিনি মনে করেন।

এমআর/ইএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর