শনিবার, ৪ মে, ২০২৪, ঢাকা

বিদেশে পাচার হওয়া টাকা ফেরানো সম্ভব হবে?

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১৮ জুন ২০২২, ১২:০৫ পিএম

শেয়ার করুন:

বিদেশে পাচার হওয়া টাকা ফেরানো সম্ভব হবে?
ছবি: সংগৃহীত

জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামালের উত্থাপিত বাজেটের একটি অংশ নিয়ে রাজনীতি ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। ২০২২-২৩ অর্থ বছরের উত্থাপিত বাজেটে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ বা সম্পদ কর দিয়ে বৈধ করার সুযোগই হলো সেই আলোচনা কিংবা সমালোচনার অংশ। 

অনেকেই মনে করেন— উত্থাপিত বাজেটে অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাব পাচার হওয়া অর্থ বা সম্পদ কর প্রদানের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। 


বিজ্ঞাপন


এদিকে আয়কর অধ্যাদেশে নতুন একটি বিধান সংযোজনের প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। সেই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বিদেশে অবস্থিত যেকোনো সম্পদের কর পরিশোধ করা হলে আয়কর বা অন্যকোনো কর্তৃপক্ষ এনিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলবে না। এজন্য অর্থ, স্থাবর ও অস্থাবর  সম্পদের ওপর আলাদা কর হার ধার্য করে দিয়েছেন তিনি। অর্থমন্ত্রীর ধার্য করা হার অনুযায়ী কর দিলেই বিদেশে পাচার করা সম্পদ বা অর্থ বৈধভাবে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনতে পারবে। 

বাজেট বক্তব্যে এই প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেন, পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে নতুন এই বিধান সহায়তা করবে।

‘দুদকের কাজে নতুন বিধান বাধা হবে না’
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলেছেন, অর্থ মন্ত্রণালয় নতুন এই বিধান করার আগে মানি লণ্ডারিং নিয়ে কাজ করে এমন কারও সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি। 


বিজ্ঞাপন


তিনি মনে করেন- সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা হলে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা হতো। সেক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতেও সরকারের জন্য সহজ হতো। সরকারের উচিত ছিল কালো টাকা সাদা করা বা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে ভারতের আইনে কি ধরনের ইফেক্ট বা আউটকাম হয়েছিল তা খতিয়ে দেখা। আসলে পাচার হওয়া অর্থ নিয়ে এত আলোচনা হয়েছে যে আমার মনে হয়েছে সরকার বিষয়টি নিয়ে পর্যুদস্ত হয়ে গেছে। এজন্যই হয়তো সরকার টেস্ট কেস হিসেবে সুযোগ এই সুযোগ দিয়েছে।

খুরশিদ আলম বলেন, কয়েক বছর আগে এ ধরনের উদ্যোগ নিয়ে ভারত ভালো ফল পায়নি। তার দাবি— বাজেটে যাই অনুমোদন হোক না কেন পাচার করা অর্থের উৎস সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে প্রশ্ন করতে দুদকের জন্য কোনো বাধা থাকবে না। 

দুদকের এই আইনজীবী বলেন, দুর্নীতি দমন ও মানি লন্ডারিংয়ের আইনগুলো বিশেষ আইন। এখন সংসদে অর্থ আইনে যাই বলা হোক ক্রিমিনাল অফেন্সের জন্য কোনো সমস্যা হবে না। ট্যাক্স দিয়ে টাকা হয়তো হালাল করতে পারবেন। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনে অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন ও আইনগত প্রক্রিয়া নেওয়ার সুযোগ আছে। তাই দুদকের অর্থ পাচার মামলার ক্ষেত্রে এর কোনো প্রভাব পড়বে না।

অর্থ ফিরবে নাকি পাচার বাড়বে
গবেষক ও অর্থনীতিবিদদের মতে— আইনটি করার মাধ্যমে সরকার প্রথমবারের মতো স্বীকার করেছে দেশ থেকে বিপুল অর্থ পাচার হয়েছে। এর আগে ২০২১ সালের শেষ দিকে ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন জানিয়েছিলেন কানাডায় অর্থ পাচারের যে গুঞ্জন আছে তার কিছু সত্যতা পেয়েছেন। 

ওই সময় তিনি আরও ২৮টি ঘটনার তথ্য তাদের কাছে আছে বলে উল্লেখ করেন। এরপরই তার এই বক্তব্য নিয়ে শোরগোল উঠেছিল। কিন্তু পাচার হওয়া সে অর্থ ফিরিয়ে আনতে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি সরকারকে। অথচ এখন অর্থমন্ত্রী নিজেই কর দিয়ে পাচার করা অর্থ ও সম্পদ ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন।

তবে পাচারকারীদের দায়মুক্তির এই সুযোগ অর্থপাচার প্রতিরোধ কতটা কার্যকরী হবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন গবেষক ও অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। 

গবেষক ও এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, এতে প্রেরিত অর্থের ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি নানা পর্যায়ের লোকজনের যুক্ত হওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। অর্থপাচারের সুযোগ নেওয়ার পর আবার দায়মুক্তির সুযোগও তৈরি হয়। এজন্য অর্থ কতটা ফিরে আসবে তা দেখার আগে দেখতে হবে- দায়মুক্তির মাধ্যমে আইনি ও নৈতিক ভিত্তিগুলোকে আমরা কতটা দুর্বল করে দিচ্ছি কিনা।

গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই)। ২০২০ সালে ওয়াশিংটনভিত্তিক এই গবেষণা প্রতিষ্ঠান  বলেছিল, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়।

তারা বলেছিল, ২০০৮ সালের পরে বাংলাদেশে পণ্যের মূল্য ঘোষণায় গড়মিল দেখিয়ে অর্থ পাচারের পরিমাণ বেড়েছে। ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ ১ হাজার ১৫১ কোটি ৩০ লাখ ডলার বিদেশে চলে গেছে।

গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, এখন কর দিয়ে বৈধ করার মতো সুযোগ দিলে পাচার হওয়া অর্থ ফিরে আসবে- এটি একেবারেই অযৌক্তিক ও অন্যায় চিন্তা। বরং এর মাধ্যমে অপরাধের যে দায়মুক্তি দেওয়া হলে তা পাচার প্রবণতা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। এ ধরণের ব্যবস্থা টাকা ফেরত আনার চেয়ে টাকা বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতাকে উৎসাহিত করবে। একই সঙ্গে আমরা জানি- দেশ থেকে টাকা পাচার ঠেকাতে খুব কার্যকর ব্যবস্থা এখনও তৈরি হয়নি। সেটি না থাকায় এ ধরনের প্রণোদনা কেবল টাকা পাচারকেই উৎসাহিত করবে।

কালো টাকা ফেরেনি, পাচারের অর্থ ফিরবে?
এদিকে বাংলাদেশ কালো টাকা কর দিয়ে দেশের অর্থনীতির মূল ধারায় ফিরিয়ে আনার সুযোগ দীর্ঘকাল ধরেই দিয়ে যাচ্ছিল। যদিও এতে সুফল আসেনি খুব একটা। রাজস্ব ও অর্থ বিভাগের বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়া প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশে এ পর্যন্ত ১৬ বার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি আয়কর আইনে নির্দিষ্ট পরিমাণ জরিমানা ও কর দিয়ে পুঁজিবাজার এবং আবাসন খাতে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগও দেওয়া হয়েছিল। 

এছাড়া ‍পুরনো একাধিক বছরের কালো টাকা সাদা করার সুযোগও দেওয়া হয়েছিল। অথচ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় জরিমানা দিয়ে বৈধ করার মোট টাকার পরিমাণ মাত্র প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা।

ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার যে চেষ্টা করা হয়েছিল তাতে খুব একটা লাভ হয়নি। বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে- কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার পরেও খুব একটা সুবিধা বা রাজস্বতে খুব একটা পরিবর্তন আমরা দেখিনি। আবার টাকা বাইরে নিয়ে গেছেন তিনি উদ্দেশ্যমূলকভাবেই নিয়েছেন। ফেরত আনার জন্য তো নেননি। তার যেহেতু মূল উদ্দেশ্য ছিল বাইরে নেওয়া তিনি সেটি ফেরত আনবেন কেন?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি এই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বলেন, এসব বিষয় আবার শুধু বাংলাদেশের রাজস্ব ব্যবস্থাই নয়, অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে এগুলো সংশ্লিষ্ট। সেগুলো বিবেচনা করলে এটা কতটা সম্ভব হবে তাই দেখার বিষয়।

বিশ্বে বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী- প্রতি বছর দেশের টাকা পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও থাইল্যান্ডসহ অন্তত দশটি দেশে।

এর আগে সরকারের দিক থেকে এসব তথ্যকে কখনোই আমলে নেওয়া হয়নি। এছাড়া গুরুত্বও দেওয়া হয়নি। তবে এবার বাজেটে অর্থমন্ত্রীর নতুন প্রস্তাবের পক্ষে বলতে গিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বলেছেন, অনেক টাকা পাচার হয়ে গেছে এবং সে কারণেই তারা একটি সুযোগ দিচ্ছেন। যদিও এই সুযোগের সুফল পেলে তা রাখা হবে না বলেও সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেছেন তিনি। 

সূত্র: বিবিসি 

এইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর