দেশের অর্থনীতির একজন গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারক পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের চিফ ইকোনমিস্ট বা প্রধান অর্থনীতিবিদ। তিনি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি, মুদ্রানীতি এবং ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা বিশ্লেষণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ও পরিচালনা পর্ষদকে নীতিগত দিকনির্দেশনা দেন। এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে শুধু স্বমী-স্ত্রী সম্পর্ক থাকায় পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগীকে বসাতে তোড়জোড় শুরু হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। এরই মধ্যে নিয়োগের সব ধরনের প্রস্তুতিও সম্পন্ন করেছেন তিনি। অথচ এ-সংক্রান্ত তেমন কোনো অভিজ্ঞতাই নেই তার। বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
তারা বলেন, প্রধান অর্থনীতিবিদ পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই পদে যিনি থাকেন, তিনি দেশের অর্থনীতির একজন নীতিনির্ধারক ও পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেন। এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে নিজের ‘অনভিজ্ঞ’ স্ত্রীকে নিয়োগ দেওয়ার পাঁয়তারা করছেন ডেপুটি গভর্নর হাবিবুর। তার স্ত্রী সায়েরা ইউনূস বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কর্মরত। আগামী ৩ জুলাই তার অবসরে যাওয়ার কথা। এর আগে একই পদে দায়িত্ব পালন করেন ডেপুটি গভর্নর হাবিবুর রহমান। তার প্রধান অর্থনীতিবিদ হওয়া নিয়েও ছিল বিতর্ক।
বিজ্ঞাপন
সূত্রে জানা গেছে, আগামীকাল মঙ্গলবার প্রধান অর্থনীতিবিদ পদে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাক পেয়েছেন চারজন। তারা হলেন– বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক সায়েরা ইউনূস, ইজাজুল ইসলাম, পরিচালক সেলিম আল মামুন ও অর্থনীতিবিদ ড. আক্তার হোসেন। সাক্ষাৎকার বোর্ড গঠনের দায়িত্বে ছিলেন ডেপুটি গভর্নর হাবিবুর নিজেই। যে কারণে এই নিয়োগের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ফয়সাল আহমেদ প্রধান অর্থনীতিবিদের পদ ছেড়ে দিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগের নির্বাহী পরিচালক হাবিবুর রহমানকে প্রধান অর্থনীতিবিদের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। কোনো ধরনের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই অফিসিয়াল নির্দেশনার মাধ্যমে ২০২২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি হাবিবুরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০২৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি ডেপুটি গভর্নরের দায়িত্ব গ্রহণ করলে পদটি ফাঁকা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, হাবিবুর-সায়েরা দম্পত্তি তাদের কর্মজীবনে আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী ছিলেন। বিগত সরকারের আস্থাভাজন হওয়ায় স্বামী-স্ত্রী দুজনই বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ পদে আসীন হন। তারা বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাড়তি সুবিধা নিয়েছেন। তৎকালীন হাসিনা সরকারের আস্থাভাজন হওয়ায় দুই জনই বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত হন। আওয়ামী লীগের সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক দেখা গেছে সায়েরা ইউনূসের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, নতুন সরকারের আমলে গভর্নরের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে হাবিবুর তার স্ত্রীকে প্রধান অর্থনীতিবিদ পদে নিয়োগের সব ধরনের প্রস্তুতিও সম্পন্ন করেছেন। অথচ তার স্ত্রীর এ-সংক্রান্ত তেমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই। কর্মকর্তারা বলছেন, এভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জালিয়াতি শুরু হলে দেশের আর্থিক খাত বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে।
বিজ্ঞাপন
সাক্ষাৎকার বোর্ডে থাকা এক কর্মকর্তার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে চারটি সিভি পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে সায়েরা ইউনূসের সিভিও আছে। তিনি যে হাবিব সাহেবের স্ত্রী, এটা আমাকে জানানো হয়নি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কারও বিষয়ে আমার কাছে সুপারিশও করা হয়নি।’
এদিকে, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে প্রশ্নবিদ্ধ ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হলে তা অর্থনীতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী ঢাকা মেইলকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ মানে হচ্ছে তিনি দেশের অর্থনীতি পরিচালনার একটা ভিত্তির মতো। মুদ্রানীতি কেমন হবে, মুদ্রাবাজার নীতি-পলিসি এসব কিছুতেই একজন প্রধান অর্থনীতিবিদের কাজ। এ ধরনের একটা পজিশনে একজন অভিজ্ঞ এবং সব থেকে যোগ্য ব্যক্তিকে বসানো উচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান ঢাকা মেইলকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো নিয়োগে এ ধরনের চাতুরি হওয়ার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্যই সব মানদণ্ড মেনেই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে। এ ক্ষেত্রে ডামি বোর্ড করার কোনো সুযোগ নেই।
টিএই/এইউ

