সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

এনবিআরে অচলাবস্থা: প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা চান আন্দোলনকারীরা

মহিউদ্দিন রাব্বানি
প্রকাশিত: ১৮ মে ২০২৫, ০৩:১৪ পিএম

শেয়ার করুন:

NBR
চার দিন ধরে এনবিআরে চলছে কলম বিরতি। ছবি: সংগৃহীত
    • দ্রুত ইতিবাচক সমাধান আশা করছেন আন্দোলনকারীরা
    • সংস্কার কমিটি সুপারিশ প্রকাশ না করা সন্দেহজনক
    • একতরফা অধ্যাদেশ জারির ফলে অচলাবস্থার সৃষ্টি
    • অচলাবস্থা নিরসনের পথ খুঁজছে সরকারও
    • দাবি না মানলে আরও কঠোর কর্মসূচির ইঙ্গিত

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে দুটি নতুন বিভাগ—রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ—গঠনের সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আন্দোলন করছেন। টানা চতুর্থ দিনেও (রোববার) চলছে কলম বিরতি কার্যক্রম। এতে দেশের আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের সব দফতরে নিয়মিত কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ইতিবাচক নির্দেশনা কামনা করছেন।


বিজ্ঞাপন


গতকাল শনিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনবিআর কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার নিপুণ চাকমাও সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে আমরা সরকারের সঙ্গে আলোচনার জন্য অপেক্ষা করছি।

যুগ্ম কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আমরা সংস্কার চাই, তবে তা বাস্তবসম্মত, অংশীজনদের মতামত নিয়ে ও এনবিআর কর্মকর্তাদের দক্ষতা-অভিজ্ঞতা স্বীকৃত হওয়া উচিত।

এদিকে দেশব্যাপী এনবিআর কর্মকর্তাদের কলম বিরতি কর্মসূচিতে সৃষ্ট অচলাবস্থা নিরসনের পথ খুঁজছে অন্তর্বর্তী সরকারও। ইতোমধ্যে এনবিআর চেয়ারম্যানসহ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করেছেন। শিগগিরই সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে বৈঠক হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

আরও পড়ুন

এনবিআর বিলুপ্তির ব্যাখ্যায় যা বলল সরকার

এনবিআরের একটি সূত্র জানায়, গতকাল শনিবার চেয়ারম্যান এনবিআরের মেম্বারদের সঙ্গে বৈঠক করেন। অধিকাংশ সদস্যই ইতিবাচকভাবে সমাধানের উপায় খুঁজে বের করার আহ্বান জানান।

আন্দোলনকারীদের একজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা আভাস পেয়েছি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের। দুই-এক দিনের মধ্যেই তা হতে পারে বলে আশা করছি।

NBR2
কঠোর কর্মসূচির ইঙ্গিত আন্দোলনকারীদের। ছবি: সংগৃহীত

এনবিআর সংস্কারের বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংস্কার কমিটি সুপারিশ প্রকাশ না করা সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। সংস্কার কমিশনের পরামর্শ উপেক্ষা করে একতরফাভাবে অধ্যাদেশ জারির ফলে এক ধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

কেন এই আন্দোলন?

গত ১২ মে জারি করা অধ্যাদেশের মাধ্যমে এনবিআর বিলুপ্ত করে নতুন দুটি বিভাগ গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জারিকৃত অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, পলিসির প্রধান হতে পারেন 'যেকোনো যোগ্য সরকারি কর্মকর্তা' এবং ম্যানেজমেন্ট প্রধান হবেন 'রাজস্ব অভিজ্ঞতা সম্পন্ন' ব্যক্তি। এই অস্পষ্টতার সুযোগে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়নের আশঙ্কা করছেন আন্দোলনকারীরা। এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তিনটি মূল দাবি উত্থাপন করেছেন:

১. অধ্যাদেশ বাতিল: তারা দাবি করছেন, অংশীজনদের মতামত উপেক্ষা করে জারি করা এই অধ্যাদেশ অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।

২. পরামর্শক কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ: এনবিআর সংস্কার পরামর্শক কমিটির প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে।

৩. অংশগ্রহণমূলক সংস্কার: সকল অংশীজনের মতামত নিয়ে সমন্বিত, অংশগ্রহণমূলক ও টেকসই রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কার করতে হবে।

আন্দোলনের বর্তমান অবস্থা

আন্দোলনের অংশ হিসেবে শুরুতে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিক্ষোভ করেছেন। পরবর্তী সময়ে সারাদেশের সকল দফতরে কলম বিরতি পালনের ঘোষণা দেন আন্দোলনকারীরা। আজ চতুর্থ দিনের মতো এ কর্মসূচি চলছে।

আরও পড়ুন

এনবিআর ভেঙে দুই বিভাগ, ক্ষোভে ফুঁসছে কাস্টমস ও আয়কর ক্যাডার

এনবিআরের এক সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, দাবি না মানলে আমাদের আরও কঠোর কর্মসূচিতে যেতে হবে।

সরকারের ব্যাখ্যা

এর আগে অদ্যদেশ জারির পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়েছে, এনবিআরের পুনর্গঠন কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি, স্বার্থের দ্বন্দ্ব হ্রাস এবং দক্ষতা উন্নয়নের লক্ষ্যে করা হয়েছে। একই সংস্থা করনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করলে স্বার্থের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়; তাই এই পৃথকীকরণ প্রয়োজনীয়।

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, এই পুনর্গঠন রাজস্ব আদায়ে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না এবং কর্মকর্তাদের স্বার্থ সংরক্ষিত থাকবে।

এনবিআর সংস্কার কমিটির সদস্য ফরিদ উদ্দিন বলেন, নেতৃত্ব নিয়োগ হলো সংস্কারের মাত্র ৫ শতাংশ কাজ, কিন্তু তা ভুল হলে বাকি ৯৫ শতাংশ কাজই ভেস্তে যাবে। তিনি বলেন, সংস্কার কমিশনের যে সুপারিশ ছিল, সেটিই সংকটের সমাধানের পথ। অন্য কোনো পথ দেখি না।

এনবিআর বাতিলের কার সুবিধা?

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে দুটি নতুন বিভাগ—রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ—গঠনের সিদ্ধান্তের পেছনে সরকারের যুক্তি এবং এই পরিবর্তনের ফলে কারা লাভবান হতে পারে এমন আলোচনা চলছে বিভিন্ন মহলে।

NBR3
আন্দোলনে স্থবির এনবিআর। ছবি: সংগৃহীত

সরকারের যুক্তি হলো, এনবিআর দীর্ঘদিন ধরে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত প্রায় ৭.৪ শতাংশ, যা এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। এই পরিস্থিতি উন্নত করতে করনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব পৃথক করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন

এনবিআর বিলুপ্তিতে রাজস্ব আদায়ে কোনো প্রভাব পড়বে না: অর্থ উপদেষ্টা

সরকারের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, একটি প্রতিষ্ঠানকে একই সঙ্গে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিলে স্বার্থের সংঘাত ও অদক্ষতা তৈরি হয়। কর আদায়ের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা প্রায়ই কর ফাঁকিদাতাদের সঙ্গে সমঝোতা করে জনস্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত করেন।

কারা লাভবান হতে পারেন?

১. করদাতারা: নীতি ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব পৃথক হলে করব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়বে, যা করদাতাদের জন্য সুবিধাজনক হবে।

২. বিনিয়োগকারীরা: স্বচ্ছ ও পূর্বানুমেয় করনীতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে পারে, যা বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

৩. সরকার: কর আদায়ে দক্ষতা বৃদ্ধি পেলে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে, যা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সহায়তা করবে।

কারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন?

এনবিআর কর্মকর্তারা: অনেক কর্মকর্তা আশঙ্কা করছেন যে, নতুন কাঠামোতে তাদের ভূমিকা কমে যাবে বা তারা উপেক্ষিত হবেন।

অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ: বর্তমানে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব এনবিআরের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নতুন কাঠামোতে এই ভূমিকা পরিবর্তিত হতে পারে, যা প্রশাসনিক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।

এমআর/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর