দেশে ব্যবসা পরিচালনায় শীর্ষ পাঁচটি প্রতিবন্ধকতার অন্যতম দুর্নীতি। প্রতি চারটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্তত একটি প্রতিষ্ঠান ঘুষের মুখোমুখি হতে হয়। এমন বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে বিশ্বব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে।
আইএফসির এপ্রিলে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের ডায়াগনস্টিক’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ঘুষকে ‘উপহার’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কেউ একে বলছেন ‘উপহার’, কেউ বলছেন ‘প্রয়োজনীয় তেল’। তবে অর্থনীতিবিদ ও বিনিয়োগ বিশ্লেষকরা একে বলছেন স্পষ্ট দুর্নীতি।
বিজ্ঞাপন
দেশের বেসরকারি খাতের ডায়াগনস্টিকের (সিপিএসডি) উদ্দেশ্য হলো বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগের সুযোগ শনাক্ত করা। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে তৈরি করা এই প্রতিবেদনে দেশের সামগ্রিক ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
আইএফসি দেশের ব্যবসা প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্রে দুর্নীতির এসব তথ্যের রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেছে ওয়ার্ল্ডওয়াইড গভর্নেন্স ইন্ডিকেটর (ডব্লিউজিআই) প্রকাশিত ২০২২-এর প্রতিবেদন। ডব্লিউজিআই হলো একটি গবেষণা ডেটাসেট, এর মাধ্যমে শিল্প ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্যোগ, নাগরিক ও বিশেষজ্ঞ সমীক্ষার উত্তরদাতা প্রদত্ত শাসনের মান সম্পর্কে মতামতের সারসংক্ষেপ তুলে ধরে।
দেশের ব্যবসা পরিবেশের ক্ষেত্রে জটিলতা হিসেবে দুর্নীতি অন্যতম কারণ। বিশ্বব্যাপী পরিচালিত গভর্নেন্স ইন্ডিকেটর অনুসারে, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ২১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৮২তম স্থানে রয়েছে।
আইএফসির প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশি চারটি সংস্থার মধ্যে একটি (২৩ শতাংশ) কমপক্ষে একবার ঘুষের অনুরোধের মুখোমুখি হয়েছে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৩৫ শতাংশ সংস্থাকে বৈদ্যুতিক সংযোগ বা অপারেটিং লাইসেন্স পাওয়ার জন্য উপহার দিতে হয়েছে। ৭২ শতাংশ সংস্থা আমদানি লাইসেন্স পাওয়ার জন্য ‘উপহার’ (ঘুষ) দেওয়ার কথা ভাবে এবং ১৯ শতাংশ সংস্থাকে কর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে উপহার দিতে হয়।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে এমন ঘটনা দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক গড়ের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি। এতে বাংলাদেশে দুর্নীতি দমনে কাজ করা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বলা হয়, বাংলাদেশে দুর্নীতিবিরোধী নীতি এবং বিধিবিধান রয়েছে, কিন্তু তাদের প্রয়োগের অভাব রয়েছে। এমন প্রতিবেদন রয়েছে যে, ঘুষ ও দুর্নীতির তদন্তকারী প্রধান সরকারি সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এগুলো বাংলাদেশের চলমান সমস্যা। একারণে দেশে বিনিয়োগ আসছে না। স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারী সবাই নিরুৎসাহিত হচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এগুলো দিতে চায় না। কারণ তাদের দেশে করপোরেট কালচারে সুশাসন রয়েছে।’
এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘আমাদের দায়বদ্ধতা বাড়িয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে। ফরেনসিক ইনভেস্টিগেশন করা, নজরদারি বাড়ানো, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে।’
অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ঘুষ প্রতিযোগিতা প্রতিষ্ঠানের পরিচালন খরচের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। ফলে ব্যবসায়িক নিয়মকানুন লঙ্ঘন হয়।
এদিকে, বাংলাদেশ বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের (এফডিআই) গন্তব্যস্থল হিসেবে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। ১৯৯০ এর দশকের শেষের দিক থেকে বিনিয়োগ প্রবাহের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি, যা ২০১৩ সালে জিডিপির ১ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছেছিল। এরপর ২০১৫ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নিয়ন্ত্রক অনিশ্চয়তার কারণে মন্দা শুরু হয়। ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এফডিআই জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসে। যা সমকক্ষ প্রতিযোগী দেশগুলোরদের মধ্যে সর্বনিম্ন। গত দশকে বেশির ভাগ এফডিআই ছিল জ্বালানি খাতে। তবে এফডিআইয়ের বেশির ভাগই ছিল বাংলাদেশে কর্মরত বিদ্যমান বিদেশি সহযোগীদের পুনরায় বিনিয়োগের আকারে।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ঘুষ সংস্কৃতির কারণে আমাদের দেশে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারিয়ে যায়। ব্যয় বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের বেসরকারি খাত অর্থনীতির প্রাণ। তবে দুর্নীতি, ঘুষ ও অব্যবস্থাপনার কারণে সেটি দমবন্ধ পরিস্থিতিতে পড়ে আছে। উন্নত ব্যবসা পরিবেশ গড়তে হলে সুশাসন নিশ্চিত করা, আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং স্বচ্ছতা-দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠা করাই এখন সময়ের দাবি।
এমআই/জেবি