আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সংস্থাটিতে ভারতীয় কর্মকর্তাদের প্রভাব ও বাংলাদেশের ওপর আরোপিত শর্ত পূরণ না হওয়ায় ৪৭০ মিলিয়ন ডলার ঋণের বাকি অংশ পাওয়া নিয়ে এই শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এছাড়াও সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল নয় বাংলাদেশ। তাদের ঋণ না নিয়েও আমরা চলতে পারব। এসব কারণে বিভিন্ন মহলে নেতিবাচক প্রশ্ন ও ঋণ না পাওয়ার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
গত ১৭ এপ্রিল আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর শেষে সংবাদ সম্মেলনে জানায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের কিস্তি এখনই পাচ্ছে না বাংলাদেশ। সংস্থাটির শর্ত পূরণে পিছিয়ে থাকায় চলমান ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি আবারও ঝুলে গেছে। ফলে বহুল প্রত্যাশিত ঋণের কিস্তি ছাড়ের নিরাশার মধ্যেই সংস্থাটির প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ সফর শেষ করেন। কবে নাগাদ ঋণের কিস্তি ছাড় হবে সে বিষয়েও কোনো ধারণা দিতে পারেনি প্রতিনিধি দলটি।
ফিরে যাওয়ার আগে প্রতিনিধি দলটির সদস্যরা সংবাদ সম্মেলনে জানান, রাজস্ব ঘাটতি, অপর্যাপ্ত রিজার্ভ, বাজারভিত্তিক ডলার রেট, ভর্তুকি বন্ধ, ব্যাংক খাত সংস্কারসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে এবং সেটা চলতে থাকবে। ঋণের কিস্তি পাওয়ার বিষয়ে আইএমএফের বোর্ড মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে শর্ত পরিপালনের দিক থেকে অনেক অগ্রগতি হয়েছে বাংলাদেশের।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন—
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ঢাকা মেইলকে জানান, আইএমএফ-এ ভারতীয় কর্মকর্তাদের একটি প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। তারা বিভিন্নভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। ডলার মার্কেট পুরোপুরি বাজারভিত্তিক না করায় তারা সন্তুষ্ট হতে পারেনি। কিন্তু এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকও ডলারের দাম পুরোপুরি বাজামুখি করতে রাজি নয়। একাধিকবার গভর্নর এই কথা মিডিয়ার সামনে বলেছেন। এখন বাজারের ওপর ডলারের দাম ছেড়ে দিলে ডলারের দাম ১৫০ টাকায় উঠে যেতে পারে। তাহলে দেশে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে। অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, তাছাড়া বর্তমান গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সাবেক আইএমএফ কর্মকর্তা হওয়ার কারণে সফররত আইএমএফ দলের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলেছেন। কিন্তু আগের সরকারের আমলে সেই চিত্র ছিল পুরোপুরি ভিন্ন। আগের সরকার ঋণ পাওয়ার জন্য যেকোনো শর্ত পালন করার জন্য ‘স্যার স্যার’ করত ও রাজি হয়ে যেত। আর এখন বাংলাদেশ বলছে প্রতি মাসে তিন বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাচ্ছি আমরা। আর মাত্র ৪৭০ মিলিয়ন ডলারের ঋণের জন্য দেশের বারোটা বাজাতে দেব না।
এদিকে মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) বিকেলে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ এখন আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল নয়। আইএমএফের সব শর্ত মেনে আমরা ঋণ নিতে চাই না।
অন্যদিকে আইএমএফের ঋণ এখন দেশের অর্থনীতির জন্য খুব বেশি প্রয়োজনীয় নয় বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে স্থানীয় সময় গত শুক্রবার আইএমএফের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর বাংলাদেশ মিশনের প্রেস মিনিস্টার গোলাম মর্তুজাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বাংলাদেশে চলমান সংস্কার নিয়ে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি নিয়ে বিশ্বে একটা ঝড় বইছে। এর প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতে এবং বাংলাদেশে কতুটুক পড়বে, তা নিয়ে পর্যালোচনা চলছে। এজন্য আইএমএফও কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। এসব কারণে তাদের সঙ্গে সমাধানের গন্তব্যে এখনো যাওয়া সম্ভব হয়নি।
গভর্নর বলেন, কিছু জায়গায় তাদের আরও কাজ করতে হবে। তাদের সঙ্গে দরকষাকষি বা নীতি আলোচনা চলছে। কিস্তি পাওয়া গেলে ভালো। না পেলেও কোনো ক্ষতি হবে না। তাদের সঙ্গে এখনো ঐকমত্য পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। পৌঁছাতে না পারলে খুব একটা অসুবিধা হবে, তাও নয়। বাংলাদেশের অবস্থা ভঙ্গুর নয়। যদি ঋণ না হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতি যেভাবে চলছে, সেভাবেই চলবে।
সবমিলিয়ে, আইএমএফের কিস্তি পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও সরকার এটিকে খুব বড় সংকট হিসেবে দেখছে না। তবে এই অবস্থান আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ও ভবিষ্যৎ ঋণ সুবিধাগুলোর ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে। তবে আইএমএফের প্রতিনিধি দলের সাথে এবারের বৈঠকটি ছিল একটি সাহসের সংকেত।
টিএই/জেবি

