বৃহস্পতিবার, ২২ মে, ২০২৫, ঢাকা

এলডিসি উত্তরণ বিলম্বিত করতে জাতিসংঘকে অনুরোধের আহ্বান

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:৩৭ পিএম

শেয়ার করুন:

এলডিসি উত্তরণ বিলম্বিত করতে জাতিসংঘকে অনুরোধের আহ্বান
থিঙ্ক ট্যাঙ্ক চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ আয়োজিত গোলটেবিল। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বাসযোগ্য মূল্যায়ন এবং জনরায়ের ভিত্তিতে এলডিসি উত্তরণ বিলম্বিত করতে জাতিসংঘকে অনুরোধের আহ্বান জানিয়েছেন নীতিনির্ধারক ও বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এলডিসি উত্তরণের ফলে দারিদ্র্য বৃদ্ধির সম্ভাব্য ঝুঁকি ও তথ্য-উপাত্তের অনির্ভরযোগ্যতা বিবেচনা করে উত্তরণ বিলম্বিত করতে যথার্থ সময় পর্যন্ত প্রদানে অনুরোধ করা উচিত।

বুধবার (২৩ এপ্রিল) থিঙ্ক ট্যাঙ্ক চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে এই আহ্বান জানানো হয়।


বিজ্ঞাপন


বৈঠকে চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের গবেষণা প্রধান ইশতিয়াক বারী তার মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় বলেন, বাংলাদেশের আসন্ন এলডিসি উত্তরণ দেশের ৭১.৫% রপ্তানিকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে, যেখানে ইইউতে ৮.৭%, যুক্তরাজ্যে ৯.১% এবং জাপানে ফুটওয়্যার ও পোশাকের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে ১৫.৮% পর্যন্ত শুল্ক বৃদ্ধির পূর্বাভাস রয়েছে। এছাড়াও, স্বল্পোন্নত দেশ তহবিল থেকে রেয়াতি জলবায়ু অর্থায়ন এবং জলবায়ু অভিযোজন সহায়তা লাভের সুযোগ হারাবে। সুনির্দিষ্ট কাঠামোগত সংস্কার, বৈচিত্র্যময় বাজার কৌশল এবং রাজস্ব সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া উত্তরণের ফলে অর্থনৈতিক লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ বেশি হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ যখন এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন দেশের মোট রফতানির ৮১ শতাংশ তৈরি পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীল এবং বাজার ও পণ্যের বৈচিত্র্য না থাকায় উত্তরণের পর বিভিন্ন প্রধান বাজারে ও পণ্য খাতে শুল্ক বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। এতে আমরা শুধু বাণিজ্যিক ক্ষতির মুখোমুখি হবো না, বরং গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সহায়তা হারাতে পারে। উত্তরণের পর বাংলাদেশ আর অগ্রাধিকারভিত্তিক অনুদান ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আইনি সহায়তার সুযোগ পাবে না। বাজারভিত্তিক প্রস্তুতি, কাঠামোগত সংস্কার ও আর্থিক সক্ষমতা ছাড়া এই উত্তরণ প্রক্রিয়া শুধু অগ্রাধিকার হারানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং বহুমাত্রিক ক্ষতির কারণ হতে পারে।

চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম. জাকির হোসেন খান বলেন, এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা থেকে যে ঐক্যমত উঠে এসেছে তা স্পষ্ট। বর্তমান পরিস্থিতিতে ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্জনগুলোকে অগ্রহণযোগ্য ঝুঁকির মুখে ফেলবে। এলডিসি উত্তরণ মর্যাদার প্রতীক বা নীতিগত আনুষ্ঠানিকতা কোনোটিই নয়—এটি একটি গভীর রাজনৈতিক ও কাঠামোগত পরিবর্তন। অ্যাঙ্গোলা, নেপাল এবং কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলো বিলম্ব করতে চেয়েছিল এবং মিয়ানমার পুরোপুরি অসম্মতি জানিয়েছিল—উচ্চাকাঙ্ক্ষার অভাবের জন্য নয়, বরং সংস্কার প্রস্তুতির অভাবের কারণে। বাংলাদেশও একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। স্বচ্ছ জিডিপি তথ্য, ব্যাংকিং খাতে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার বা অর্থবহ কর-জিডিপি অনুপাতে অগ্রগতি ছাড়া, আমরা যোগ্যতাকেই প্রস্তুতি বলে ভুল করার ঝুঁকিতে আছি। সংস্কার ছাড়া উত্তরণ উন্নতি তো নয়ই—উল্টো দায়বদ্ধতা এড়ানো আর জনগণের জীবিকাকে বিপন্ন করা। আমাদের অবশ্যই প্রশ্ন করতে হবে: আমরা কি সত্যিই প্রস্তুত, নাকি ভিত্তি শক্তিশালী করার আগেই এলডিসি তালিকা থেকে বের হতে আগ্রহী? এখানে শুধু বাণিজ্য অগ্রাধিকারই ঝুঁকির মুখে নয়, বরং অনুদান-ভিত্তিক জলবায়ু অর্থায়ন হারানোর ঝুঁকিও রয়েছে—যা দুর্বল প্রশাসন এবং প্রাতিষ্ঠানিক জড়তার কারণে আরও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী মন্তব্য করেন: বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু এর উন্নয়নের ফাঁপা বয়ান-ভুয়া পরিসংখ্যান, ভেঙে পড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং রফতানির ভিত্তি বিপজ্জনকভাবে সংকীর্ণ অবস্থায় আছে। এলডিসি উত্তরণ ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করে হতে পারে না, প্রকৃত উত্তরণের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণে নির্বাচিত সাংসদের মাধ্যমে ম্যান্ডেট প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক বৈধতা ছাড়া কোনো মাইলফলকই অর্থবহ নয়।


বিজ্ঞাপন


লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের সোয়াস-এর অধ্যাপক মুশতাক খান মন্তব্য করেন, এলডিসি স্ট্যাটাস কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়—এটি বৈশ্বিক সুরক্ষার সাথে যুক্ত একটি আলোচনা সাপেক্ষে অর্জিত সুবিধা। বাংলাদেশ উত্তরণের পথে রয়েছে, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতিমূলক কাজ ছাড়াই। আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, বিদ্যুৎ খাতের চুক্তি দুর্নীতিতে জর্জরিত এবং পোশাক খাতের বাইরে আমাদের রপ্তানি প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ঠুটো জগন্নাথ—এমন অবস্থায় আমরা উত্তরণ করছি। এই উত্তরণ চামড়া ও খাদ্যের মতো শিল্পগুলোকে অরক্ষিত শুল্কের মুখে ঠেলে দেবে, যা ভারতীয় ও চীনা প্রতিযোগিতার মুখে ধসের ঝুঁকি তৈরি করবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক (গবেষণা) ড. ওমর ফারুক উল্লেখ করেন, প্রভাব মূল্যায়ন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রয়ে গেছে... বিশেষ করে অতীতে সম্ভাব্য বানোয়াট সামষ্টিক অর্থনৈতিক চলকগুলির উপর নির্ভরতার কারণে। আমাদের আর্থিক খাত এখনও দুর্বল এবং অর্থনীতি প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হওয়ায়, এই উত্তরণ শুরু করার আগে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য একটি বাস্তবসম্মত মূল্যায়নের ভিত্তিতে ২-৩ বছরের স্থগিতাদেশের জন্য আবেদন করা প্রয়োজন।

নাগরিক সমাজের অনুভূতি তুলে ধরেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সেক্রেটারি আইয়ুব ভুঁইয়া: ‘যখন হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন প্রতিবাদ করছে, তখন এলডিসি উত্তরণ একটি মাইলফলক নয়—এটি একটি বিভ্রম। গণতন্ত্র, আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং জবাবদিহিতা ছাড়া বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত নয়-টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে।’

টিএই/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর