মঙ্গলবার, ১৩ মে, ২০২৫, ঢাকা

‘ব্যবসায়ীরা অধিক লাভ পেলেও উৎপাদন খরচও উঠছে না কৃষকদের’

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ০১:৪৪ পিএম

শেয়ার করুন:

‘ব্যবসায়ীরা অধিক লাভ পেলেও উৎপাদন খরচও উঠছে না কৃষকদের’

বিভিন্ন কৃষিপণ্যে ব্যবসায়ীরা অধিক লাভ পেলেও কৃষকদের উৎপাদন খরচও উঠছে না বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক- খানি। সংগঠনটি বলছে- কৃষকের প্রয়োজন ন্যায্য মূল্য, ভোক্তা চায় কম মূল্য, ব্যবসায়ী চায় বেশি লাভ। কৃষকের উৎপাদিত পণ্য ভোক্তার হাতে যেতে বেশ কয়েক দফা হাতবদলের প্রক্রিয়ায় স্থানীয় ব্যবসায়ী, পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরা ব্যবসায়ীরা লাভ পেলেও সবচেয়ে কম মূল্য পান কৃষক। এমনকি উৎপাদনের খরচ ও উঠে আসে না।

বুধবার (২৩ এপ্রিল) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) আয়োজিত ‘ক্ষুদ্র কৃষকের উৎপাদিত ফসলের মূল্য বঞ্চনা’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা এসব কথা বলেন।


বিজ্ঞাপন


সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া বাংলাদেশের প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকের জন্য দীর্ঘদিনের একটি অলিখিত শোষণ-বঞ্চনার বাস্তবতা। কৃষি নির্ভরশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে সবচেয়ে অবহেলিত গোষ্ঠী আমাদের কৃষক। পৃথিবীর কৃষিপ্রধান দেশগুলোতে কৃষকের জন্য বিভিন্ন সেইফ গার্ডিং বা সুরক্ষা স্কিম থাকলেও বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো কর্মসূচি নেই। চাষাবাদের প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে উচ্চমূল্যে বীজ, সার, শ্রমিকের মজুরি, সেচ, কীটনাশক, ফসল তোলা এবং বিক্রির প্রতিটি পর্যায়ে প্রাকৃতিক নানা বৈরিতা, দুর্যোগ পেরিয়ে এসে ফড়িয়াবাজি আর ফসলের দাম নিয়ে সিন্ডিকেট এর কারসাজিতে ভুগতে হয় তাদের। অর্থনৈতিক নানা টানাপোড়ন, মূল্যস্ফীতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি- সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে উল্লেখযোগ্য কোনো বিপর্যয় ছাড়াই এ দেশের মানুষের টিকে থাকার মূলে সবচেয়ে বড় অবদান কৃষকের। অথচ নীতিনির্ধারকদের অবহেলার শিকার হয়ে এই কৃষককেই সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

বক্তারা বলেন, ফসলের উৎপাদন যত ভালোই হোক না কেন, ফসলের ন্যায্যমূল্য না পেলে কৃষকের জন্য তা সোনার ফসল হয় না, বরং গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। আপনারা সকলে এ বছরের উদ্বৃত্ত ফসল সম্পর্কে অবগত আছেন। এবারের মৌসুমে চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে; আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। এক কেজি আলুর উৎপাদন খরচ ২২-২৫ টাকা হলেও কৃষকদের তা মাত্র ১৪ টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে। ন্যায্য মূল্য না পেয়ে কৃষক ফসল আড়তে ফেলে আসছেন, গরুকে খাওয়াচ্ছেন- এমন নানা খবর গণমাধ্যমে বারবার আমাদের সামনে এসেছে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়- এবারে শীতকালে এবং রমজান মাসে সবজির দাম অন্যান্য সাম্প্রতিক বছরের চেয়ে তুলনামূলক কম থাকায় ভোক্তারা স্বস্তি পেলেও উৎপাদন খরচ বেশি থাকায় এর মাশুল দিতে হয়েছে কৃষককে। বাংলাদেশের অধিকাংশ ক্ষুদ্র কৃষক ফসল উৎপাদনের ব্যয়ভার বহনে নানাভাবে ঋণ নিয়ে ফসল ফলান। ঋণ শোধ করতে অনেকটা তড়িঘড়ি করেই কৃষক ফসল বিক্রি করে দেন। আবার, বাজারে দাম উঠা পর্যন্ত ফসল ধরে রাখার ক্ষেত্রেও পর্যাপ্ত সংরক্ষণাগার নেই, ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দ্রুত পচনশীল কৃষি পণ্য বেশিদিন ধরে রাখা যায় না। আলু সংরক্ষণে সরকারি-বেসরকারি ৩৬৬টি হিমাগার থাকলেও সবজির জন্য কোনো বিশেষায়িত হিমাগার নেই। কৃষিপণ্য বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী মানসম্মত সংরক্ষণ ব্যবস্থার অভাবে দেশে প্রতিবছর ২০-৪৪ শতাংশ সবজি ও ফলমূল নষ্ট হয়ে যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৮ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এবার কোল্ড স্টোরেজে আলু সংরক্ষণের সংকট নিয়ে দেশের গণমাধ্যমগুলোতে একাধিকবার সংবাদ হয়েছে। একদিকে হিমাগারের সংখ্যা অপ্রতুল, অন্যদিকে হিমাগারের ভাড়া বাড়িয়েছেন মালিকেরা।

লিখিত বক্তব্যে আরও জানানো হয়- দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ বছর টমেটোর বাম্পার ফলন হলেও একইভাবে ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, বাজারজাতকরণের অত্যধিক বায় এবং হিমাগার না থাকার কারণে অনেক কৃষক ক্ষেত থেকেই টমেটো তোলেননি। ফলে ক্ষেতেই পড়ে নষ্ট হয়েছে বিপুল পরিমাণ টমেটো। ভালো ফলন হওয়ার পরেও সবজি সংরক্ষণ ও মূল্য সংকটের এই দীর্ঘ চলমান প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই কৃষক ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন। দুর্গম উৎপাদনস্থল, ক্রেতা কম বিক্রেতা বেশি, বিশেষ করে পাহাড়ি ও হাওড় এলাকায় পরিবহন সংকট, ভঙ্গুর সড়ক অবকাঠামো এবং পণ্যের গুণমানজনিত সমস্যাসহ বিবিধ প্রতিবন্ধকতা ক্ষুদ্র কৃষকের ফসলের মূল্য বঞ্চনায় নিয়ামক হয়ে ওঠে।


বিজ্ঞাপন


২০১৮ সালে কৃষিপণ্য বিপণন আইন প্রণয়নের তিন বছরের মাথায় ‘কৃষিপণ্য বিপণন বিধিমালা’ তৈরি হয়, যেখানে চাল, ডাল, শাকসবজি, মাছ, ডিম, দুধ এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারের জন্য সর্বোচ্চ মুনাফার হার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। বিধিমালা অনুযায়ী কৃষক, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে যৌক্তিক মুনাফার একটি কাঠামো ঠিক করা আছে। এছাড়া বাজারভিত্তিক আলাদা কমিটি গঠন এবং জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে এই মুনাফার হার নিরীক্ষা ও বাস্তবায়নের ব্যবস্থাও থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে এই বিধিমালার কার্যকর কোনো প্রয়োগ দেখা যায় না বলে জানিয়েছেন বক্তারা।

সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সেফ অ্যাগ্রো ফুড এফোর্ট ফাউন্ডেশনের সভাপতি ড. মুহা. জয়নুল আবেদীন, সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম সিদ্দিকসহ বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্কের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ উপস্থত ছিলেন।

টিএই/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর