ভারত বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় দেশে পণ্য রফতানিতে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে। মঙ্গলবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে— নেপাল এবং ভুটানের জন্য এই সুবিধা এখনও থাকবে। তবে, ভারতীয় কর্মকর্তারা বলেছেন, পণ্য পরিবহন ব্যবস্থায় ভারতীয় বিমানবন্দরগুলোতে অনেক জট তৈরি হচ্ছিল, যার ফলে পণ্য পরিবহনে বিলম্ব হচ্ছিল। এই কারণে তারা বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় দেশে পণ্য রফতানির ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ভারতের এই সিদ্ধান্ত সাম্প্রতিক ‘সেভেন সিস্টার’ ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য এবং ঢাকায় আয়োজিত বিনিয়োগ সম্মেলনের প্রেক্ষাপটে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন— ভারতের এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধাক্কা হতে পারে। তারা মনে করেন, আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধান করতে হবে এবং পাল্টা কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার জন্য সতর্ক থাকতে হবে।
বিজ্ঞাপন
ভারতীয় সরকার বলেছে, এখন থেকে বাংলাদেশি পণ্য ভারতে আসা স্থলবন্দর বা বিমানবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে রফতানি করা যাবে না। তথ্য বলছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশকে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেওয়া হয়েছিল, যার মাধ্যমে বাংলাদেশি পণ্য ভারতের স্থলবন্দর ও বিমানবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে রফতানি হতে পারত। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বলছে, এই সিদ্ধান্ত ভারতীয় পণ্য পরিবহনে সুবিধা আনবে, বিশেষ করে তৈরি পোশাক, জুতা এবং অলঙ্কার খাতে।
ভারতের ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট অর্গানাইজেশনের (এফআইইও) মহাপরিচালক অজয় সাহাই মন্তব্য করেছেন, ‘এখন আমাদের পণ্য পরিবহন আরও বেশি সক্ষম হবে,’ কারণ বাংলাদেশ থেকে পণ্য পরিবহনের জন্য নির্দিষ্ট কিছু স্থান সংকুচিত হয়ে পড়ছিল এবং এর ফলে ভারতে বিমানবন্দরগুলোতে জট তৈরি হচ্ছিল। ফলে কার্গোগুলোর চলাচল ধীর হয়ে যাচ্ছিল এবং বিমান ফ্রেইটের ভাড়া বাড়ছিল।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ১৯৯৪ সালের জেনারেল অ্যাগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফস অ্যান্ড ট্রেডের (GATT)পঞ্চম অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সদস্য দেশগুলোর জন্য শুল্কমুক্ত বা বাধাহীন ট্রানজিট সুবিধা প্রদান বাধ্যতামূলক। এই বিধান অনুযায়ী, স্থলবেষ্টিত দেশগুলোর (যেমন বাংলাদেশ) পণ্য পরিবহনে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না। যদি ভারত বাংলাদেশকে এই ট্রানজিট সুবিধা দেয় না, তবে এটি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হতে পারে।
বিজ্ঞাপন
এছাড়া, জাতিসংঘের সিপিডিটি (UN Convention on Transit Trade of Landlocked States) চুক্তি অনুযায়ী, স্থলবেষ্টিত দেশগুলোর জন্য অবাধ ট্রানজিট সুবিধা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি স্পষ্টভাবে বলে, কোনো দেশ স্থলবেষ্টিত দেশের জন্য পণ্য পরিবহনে বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। ভারত যদি বাংলাদেশের জন্য ট্রানজিট সুবিধা বাতিল করে, তবে এটি এই আন্তর্জাতিক চুক্তির লঙ্ঘন হতে পারে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, নেপাল এবং ভুটানগামী পণ্য চালানের ক্ষেত্রে এই ট্রানজশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের কোনো প্রভাব পড়বে না। অর্থাৎ, বাংলাদেশের সাথে নেপাল বা ভুটানের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারতের নতুন সিদ্ধান্ত কোনো পরিবর্তন আনবে না।
এই সিদ্ধান্তের পর, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা ভারত বাতিল করার সিদ্ধান্তে আমরা হতবাক।’ তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের সরকারকে দ্রুত ভারতের কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া উচিত এবং অনুরোধ করা উচিত যেন এই সুবিধাগুলো অব্যাহত রাখা হয়। তবে, একইসাথে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন যে, বাংলাদেশ যেন পাল্টা কোনো পদক্ষেপ না নেয়।
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেছেন, ভারতের সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশের কিছু রফতানি প্রভাবিত হতে পারে, তবে তা ততটা গুরুতর হবে না। তিনি মনে করেন, এই সিদ্ধান্তের কারণে কিছুটা রফতানি বিলম্বিত হতে পারে এবং খরচ বাড়তে পারে।
ভারতের সিদ্ধান্তের পর আন্তর্জাতিক ব্যবসা ও পরিবহন বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, এই পদক্ষেপ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ককে কিছুটা চাপের মধ্যে ফেলতে পারে। একইসাথে, স্থলবেষ্টিত নেপাল এবং ভুটানও উদ্বেগ জানাতে পারে, কারণ তারা বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ককে প্রভাবিত হতে দেখতে পারে।
এইউ