ভোগ্যপণ্যের অন্যতম বড় পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত সয়াবিন তেল নিয়ে সবখানে চলছে ‘টম জেরি খেলা’। সাধারণ ক্রেতাদের ভাগ্যে এখন জুটছে না সয়াবিন তেল।
নিত্যপ্রয়োজনীয় সয়াবিন তেল না পেয়ে উচ্চমূল্যের সরিষার তেল কিনতে বাধ্য হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এ নিয়ে ক্রেতাদের মাঝে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
বিজ্ঞাপন
শুক্রবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) সকালে সরেজমিন বাজার পরিদর্শনে গিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে।
ক্রেতারা জানান, চট্টগ্রাম মহানগরীর সবকটি বাজারের প্রতিটি দোকানে সয়াবিন তেল নেই বলা হচ্ছে। পবিত্র শবে বরাত হওয়ায় বাজারে বেড়েছে সয়াবিন তেলের চাহিদাও। তবে বিক্রেতাদের ইচ্ছেমতো দামে কিনলে ঠিকই মিলছে সয়াবিন তেল।
ক্রেতারা বলছেন, গত ডিসেম্বরেও বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট তৈরি হয়। এরপর প্রতি লিটার ১৬৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৭৫ টাকায় বিক্রি হয় বোতলজাত সয়াবিন তেল। খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৪৯ টাকা থেকে বাড়ানো হয় ১৫৭ টাকায়। এ ছাড়া খোলা পাম তেলের লিটারও ১৪৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৫৭ টাকা করা হয়। বোতলজাত পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের দাম ৮১৮ টাকার পরিবর্তে ৮৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
এরপরও জানুয়ারি মাসের শেষের দিক থেকে আবার শুরু হয় সয়াবিন তেলের সংকট। বর্তমানে সরকারের কোনো ঘোষণা ছাড়াই প্রতি লিটার বোতালজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৯০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। তাও বিক্রি হচ্ছে শিশুদের জনপ্রিয় কার্টুন ‘টম এন্ড জেরি খেলার মতো’।
বিজ্ঞাপন
বিষয়টি ধরা পড়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের হাতেও। নানা অভিযোগের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে দেশের অন্যতম বৃহত্তম পাইকারি ভোগ্যপণ্যের বাজার খাতুনগঞ্জে দুই প্রতিষ্ঠানে সয়াবিন তেল নিয়ে টম এন্ড জেরি খেলা ধরা পড়ে। পরে অভিযান চালিয়ে দুই পাইকারি ব্যবসায়ীকে ৭০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর।
এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রামের বিভাগীয় পরিচালক ফয়েজ উল্লাহ বলেন, আমাদের কাছে তথ্য ছিল, বোতলজাত তেল বাজারে পাওয়া যাচ্ছিল না। কোম্পানিগুলো তেল সরবরাহ করছে ডিলারের কাছে। কিন্তু ডিলাররা যথাযথভাবে দোকানগুলোতে তেল সরবরাহ করছে না। থাকার পরেও তারা বলছে তেল নেই।
ফয়েজ উল্লাহ বলেন, বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রথমে মেসার্স আল আমিন স্টোর নামে একটি প্রতিষ্ঠানে আমরা আমাদের একজনকে তেল আছে কিনা খোঁজ নিতে পাঠাই। তারা তখন বলেছে তেল নেই। পরে ওই প্রতিষ্ঠানে আমরা গিয়ে তেল পেয়েছি। তাদের ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এরপর সাতকানিয়া স্টোর নামে পুষ্টি তেলের এক ডিলারের কাছে গিয়ে আমরা জিজ্ঞাসা করেছি তেল আছে কিনা। তারা আমাদের জানায় যে, তাদের কাছে কাছে তেল নেই। কোম্পানির কাছ থেকে জানতে পেরেছি, ১৩০০ কার্টুন, যা প্রায় ২৪ হাজার লিটার তেল উনাদের সরবরাহ করেছে। পরে প্রতিষ্ঠানের মালিক স্বীকার করেন তাকে ৬০০ কার্টুন তেল সরবরাহ করা হয়েছে। এর মধ্যে তিনি ৪০ কার্টুন তেল সরবরাহের হিসাব দিতে পেরেছেন। বাকিগুলোর হিসাব দিতে পারেননি। তার মানে তিনি এখানে কারচুপি করেছেন। তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
_20250214_194843280.jpg)
চট্টগ্রাম মহানগরীর ঝাউতলা বাজারের ব্যবসায়ী সকির আহমেদ বলেন, সয়াবিন তেলের পর্যাপ্ত সরবরাহ পাচ্ছেন না তারা। যে কয়টা প্রতিষ্ঠান তেল আমদানি ও পরিশোধন করে, মূলত তাদের হাতে সবাই জিম্মি। তারা বোতলজাত সয়াবিন সরবরাহ করছে না। মাঝেমধ্যে যে পরিমাণ তেল সরবরাহ করছে, তাতে অদ্ভুত সব শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। এ কারণে বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট তৈরি হয়েছে। তাই ব্যবসায়ীরা বেশি দামে বিক্রি করছে। সরকারি দামে বিক্রি না হওয়ায় লুকিয়ে বা কারসাজি করে বিক্রি করা হচ্ছে।
নগরীর কাজীর দেউরি বাজারের তেল ব্যবসায়ী ইউনুস গণি বলেন, ক্রেতারা দিনভর তেল চায়, কিন্তু সরবরাহ না পাওয়ায় ক্রেতাদের দিতে পারি না। উৎপাদন পর্যায়ে পণ্যটির সরবরাহ বন্ধ রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করায় তারা ক্রেতাদের কাছে সয়াবিন তেল বিক্রি করতে পারছেন না। পবিত্র শবে বরাতে চাহিদা বাড়ায় এই সংকট আরও প্রকট হয়েছে।
চট্টগ্রাম মহানগরীর বহদ্দারহাটের খুচরা ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সামনে রমজান মাস, এ অবস্থায় সয়াবিন তেলের সংকট সমাধান হবে বলে মনে হচ্ছে না। সাধারণ মানুষ এখন সয়াবিন ছেড়ে সরিষার তেলের দিকে ঝুঁকছে। উচ্চমূল্যের কারণে সরিষার তেলও তেমন কিনতে পারছেন না ক্রেতারা। এ নিয়ে ক্রেতাদের মধ্যে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। বাজার তদারকি বৃদ্ধি না করলে রমজানে সয়াবিন তেলের দাম স্থিতিশীল রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
ব্যবসায়ী ও ভোজ্যতেলের ডিলারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির অজুহাতে দেশের বাজারে ফের পণ্যটির দাম বৃদ্ধি করতে কৌশল নিয়েছেন মিল মালিকরা। পণ্যটির দাম বৃদ্ধির জন্য গত ৬ জানুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন তারা। তবে চাপের মুখে ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধির সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স এন্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। ফলে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখছে না মিল মালিকরা। সরবরাহ বন্ধ রেখে কৃত্রিম সংকট জিইয়ে রাখছেন তারা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বর্তমানে দেশে ভোজ্যতেল আমদানি ও পরিশোধন করে বিপণন করছে শীর্ষ কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে এস আলমের ব্যবসায়িক কার্যক্রম সীমিত করায় বর্তমানে প্রথম সারিতে আছে সিটিসহ চারটা গ্রুপ। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চার প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করছে ভোজ্যতেলের বাজার।
সরবরাহ বন্ধ রেখে বোতলজাত সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির বিষয়ে জানতে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহার মুঠোফোনে একাধিবার ফোন করে যোগাযোগ করা হলেও সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
তবে ভোজ্যতেলের শীর্ষ আরেকটি আমদানি ও রিফাইনারি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে এটা সঠিক নয়। তেল আসছে, প্যাকিং হচ্ছে, মাঠ পর্যায়ে সরবরাহ করা হচ্ছে। সংকট যেটা হয়েছে, আমাদের ধারণা কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান আমদানি বন্ধ করে দেওয়ায় সেটা সামাল দিতে একটু সমস্যা হচ্ছে।
মেঘনা গ্রুপের জিএম নাছির উদ্দিন বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠান বোতলজাত সয়াবিনের সরবরাহ স্বাভাবিক রেখেছে। আমাদের দিক থেকে কোনো ধরনের সমস্যা নেই সেটা বলতে পারি। অন্যরা কী করছে বা বাজারে সরবরাহ সংকট কেন, সেটা বলতে পারব না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি জেসমিন সুলতানা পারু বলেন, ওরা গত ডিসেম্বরের শুরুতেও একই কৌশলে বাজারে সংকট তৈরি করে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ৮ টাকা বাড়িয়েছে। একবার সুবিধা পেয়ে এখন আবারও সেই একই কাজ করছে। এভাবে বারবার সুযোগ দিলে বারবার একই কাজ করবে ব্যবসায়ীরা। তাদের সুযোগ না দিয়ে কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।
এমআইকে/এমআর

