দেশের বাজারে যখন ডিমের দাম হু হু করে বাড়ছে তখন প্রতিবেশী ভারত থেকে একটি বড় চালান এসেছে নিত্যপণ্যটির। দুই লাখ ৩১ হাজার পিস মুরগির ডিম বেনাপোল বন্দর দিয়ে দেশে ঢুকেছে। দুই এক দিনের মধ্যে সেই ডিম বাজারে পাওয়া যাবে। সব মিলিয়ে আমদানি করা এই ডিমপ্রতি খরচ পড়েছে প্রায় আট টাকা। অথচ দেশের বাজারে প্রতি ডিম ১৫ টাকার বেশি দরেও কোথাও কোথাও বিক্রি হচ্ছে। এই অবস্থায় ডিমের বাজারের কারসাজি থামবে কি না সেটা নিয়ে জনমনে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন।
এক সপ্তাহের ব্যবধানে ডজন প্রতি ডিমের দাম বেড়েছে ১০ টাকারও বেশি। গত সপ্তাহে যেখানে এক ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছিল ১৬০ টাকা করে, সেখানে এই সপ্তাহে প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকায়। কিছু কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ডজন প্রতি ডিম ১৮০ টাকাতেও বিক্রি করতে দেখা গেছে। অথচ তিন বা চার সপ্তাহ আগেও ডজন প্রতি ডিম বিক্রি হয়েছে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা দরে। হঠাৎ করেই এভাবে ডিমের দাম বাড়ার পেছনে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন
দেশের বাজারে ডিমের দামের এই অস্থিরতার মধ্যে রোববার (৬ অক্টোবর) ভারত থেকে সাড়ে সাত টন ওজনের ডিম বোঝাই ট্রাকে দুই লাখ ৩১ হাজার পিস মুরগির ডিম আমদানি করেছে ঢাকার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিডিএফ করপোরেশন। ভারতীয় রফতানি কারক কানুফ ত্রিপুরা ইন্ডিয়ার মাধ্যমে ডিমের চালান বোঝাই ট্রাকটি শনিবার রাতে বেনাপোল বন্দরে এসে পৌঁছে।
আওয়ামী লীগ সরকারে থাকার সময় গত বছরের শেষেও একবার ৬১ হাজার ডিমের একটি চালান আসে। সে সময় ১৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি ছিল। তবে দেশেই দাম কমে আসায় আর কোনো চালান আসেনি।
বিজ্ঞাপন
জানা গেছে, প্রতি ডজনের দাম পড়েছে দশমিক ৫৬ ডলার। সেই অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতিটি ডিমের মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৫ টাকা ৭০ পয়সা। প্রতি ডজন ডিমের নির্ধারিত মূল্যের ওপর ৩৩ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি বাবদ এক টাকা ৮৩ পয়সা যোগ হবে। সব মিলিয়ে প্রতিটি ডিমের আমদানি মূল্য দাঁড়াচ্ছে প্রায় সাড়ে ৭ টাকার মতো। এর সঙ্গে গুদাম ভাড়া, এলসি খরচ, ট্রাক ভাড়া যোগ হবে। সব মিলিয়ে প্রতিটি ডিমের খরচ সাড়ে ৮ টাকার কম হবে না বলে মনে করছেন আমদানি সংশ্লিষ্টরা। যদিও দেশের বাজারে এর প্রায় দ্বিগুণ দরে বিক্রি হচ্ছে নিত্যপণ্যটি।
২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে ডিমের দাম লাফ দেওয়ার পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রতিটি ডিমের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১২ টাকা বেঁধে দিয়েও দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। পরে ১৫টি প্রতিষ্ঠানকে ১৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। সে সময় প্রতিটি ডিমের আমদানি খরচ পড়ে ৭ টাকার কিছু বেশি, যা দেশের বাজারদরের চেয়ে অনেকটাই কম ছিল। তবে যে পরিমাণ ডিম আমদানির অনুমতি ছিল, সে পরিমাণ ডিম দেশে আসেনি। এর আগেই ডিমের দাম কমে যাওয়ায় আর আমদানি করেননি ব্যবসায়ীরা।
আরও পড়ুন
এবারও ভারত থেকে ডিমের একটি বড় চালান আসায় এর প্রভাব বাজারে পড়তে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে দেশের বাজারে লাল ডিমের চাহিদা বেশি। ভারত থেকে আমদানি করা ডিম সাদা। বাজারে এই ডিমের চাহিদা কিছুটা কম।
ডিমের বাজারে কেন আগুন, কী বলছেন সংশ্লিষ্টরা
গত ১৫ সেপ্টেম্বর ফার্মের মুরগির ডিম এবং ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির দাম নির্ধারণ করে দেয় কৃষি বিপণন অধিদফতর। নতুন বেঁধে দেওয়া দামে উৎপাদন পর্যায়ে প্রতিটি ডিমের দাম নির্ধারিত হয় ১০ টাকা ৫৮ পয়সা এবং পাইকারিতে ১১ টাকা শূন্য ১ পয়সা। আর খুচরা পর্যায়ে প্রতি ডজন ডিমের মূল্য নির্ধারণ করা হয় ১৪২ টাকা ৪৪ পয়সা। ফলে প্রতি পিস ডিমের দাম ধরা হয় ১১ টাকা ৮৭ পয়সা। তবে মূল্য নির্ধারণের পরও মাঠপর্যায়ে তার বাস্তবায়ন করা যায়নি। বরং হু হু করে বাড়তে থাকে ডিমের দাম।
ডিমের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত এবং সিন্ডিকেটকে দায়ী করছে বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটির সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, ডিমের দাম নির্ধারণ করা হলো। কিন্তু বাজারের চাহিদার ৮০ পারসেন্ট উৎপাদনকারী প্রান্তিক খামারিদের রাখা হয়নি। দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাজার মেকানিজম না জেনেই করপোরেটদের দিক নির্দেশনায় এই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে আর এর মাধ্যমে করপোরেট গ্রুপগুলোকে সিন্ডিকেট করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতি এই কারসাজির পেছনে জড়িত বলে অভিযোগ ওঠে। তবে সমিতির সভাপতি আমান উল্লাহ এই অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, দুই-চার-পাঁচজনের হলে হয়, লক্ষ লক্ষ মানুষের সিন্ডিকেট হয় না। বন্যার কারণে ডিমের সরবরাহ কমে যাওয়ায় ডিমের দাম বেড়েছে বলে মনে করেন তিনি। এই ব্যবসায়ী বলেন, যেই হিসেবে চাহিদা, সেই হিসাবে উৎপাদন নাই। উৎপাদন কম। তাছাড়া বন্যার কারণে অনেকগুলা ফার্ম মাইর খাইয়া গেছে, আবার বর্ষাকালে শাক-সবজি আমদানি কম। সবমিলিয়ে যে পরিমাণ ডিম উৎপাদন না থাকার কারণেই ডিমের দাম বাড়ছে।
এদিকে শনিবার (৫ অক্টোবর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন দাবি করেছে, বাজারে প্রতিটি ডিমে দুই টাকা করে বেশি নেওয়া হচ্ছে। ফলে প্রতিদিন চার কোটি ডিমে আট কোটি টাকা বেশি লাভ করা হচ্ছে। এভাবে গত ২০ দিনে ১৬০ কোটি টাকা ভোক্তাদের পকেট থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
শুধু ডিম নয়, প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামই চড়া। ক্ষমতার পালাবদলে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বাজার সিন্ডিকেট উঠে যাবে এবং দ্রব্যমূল্য কমবে বলে আশা করেছিল দেশবাসী। তবে গত দুই মাসে এর তেমন কোনো লক্ষণ নেই বাজারে।
এই বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারও স্বীকার করছে। তারা বাজার মনিটরিংয়ে টাস্কফোর্স গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। রোববার (৬ অক্টোবর) ভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজে এই তথ্য জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের ক্রীড়া উপদেষ্টা এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ।
আসিফ মাহমুদ ফেসবুকে লিখেছেন, অনেকগুলো পণ্য ডিউটি ফ্রি করার পরেও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। বাজার মনিটরিংয়ে টাস্কফোর্স গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। দ্রুতই মাঠে নামবে টাস্কফোর্স।
এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রতিদিনই বাজার মনিটরিংয়ে চালানো হচ্ছে অভিযান। রোববারও রাজধানীর নিউমার্কেট কাঁচাবাজার ও গুলশান কাঁচাবাজারে অভিযান পরিচালিত হয়। এছাড়া ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরও বাজার মনিটরিং অব্যাহত রেখেছে।
জেবি