দেশের বাজারে স্বর্ণের দাম দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, গত বছরের শুরুতে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের এক ভরির দাম ছিল ৮৮ হাজার ৪১৩ টাকা। গত ২১ মাসে দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ হাজার ২৯৫ টাকা, এবং চলতি বছরে এক ভরির দাম বেড়েছে ২৭ হাজার ৬৬৭ টাকা।
রাজনৈতিক পরিবর্তনের পাশাপাশি স্বর্ণের দাম এইভাবে বাড়ার ফলে জুয়েলারি ব্যবসায় মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। স্বর্ণের অলংকার এখন সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। তবে, দাম বাড়ার কারণে যাদের পুরনো স্বর্ণ বা অলংকার রয়েছে, তাদের সম্পদমূল্য বেড়ে যাওয়ার জন্য কিছুটা লাভ হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
স্বর্ণের দাম বৃদ্ধির মূল কারণ বৈশ্বিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতার কারণে গত ফেব্রুয়ারি থেকে দাম ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। গত এক মাসে বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম প্রথমবারের মতো আড়াই হাজার ডলার ছাড়িয়েছে, বর্তমানে তা ২ হাজার ৭০০ ডলারের কাছাকাছি।
জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা বলছেন— রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তবে স্বর্ণের দাম বৃদ্ধির ফলে প্রভাবটা বেশি। গত দুই মাসে অলংকারের বেচাবিক্রি ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কমে গেছে।
স্বর্ণের দামের সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতির সম্পর্ক গভীর। বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা দেখা দিলে স্বর্ণের দাম বাড়ে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে স্বর্ণের দাম বৃদ্ধি পায়। ২০২০ সালের আগস্টে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়, প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ২ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যায়, যা ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
গত বছর ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরুর পর স্বর্ণের দাম আবার বৃদ্ধি পেতে শুরু করে, এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের উত্তেজনাও দাম বাড়াচ্ছে। গত সপ্তাহে লেবাননে ইসরায়েলের বিমান হামলার পর স্বর্ণের দাম বেড়েছে প্রায় ২০০ ডলার।
বিজ্ঞাপন
যুক্তরাষ্ট্রের সুদের হার হ্রাসের ফলে বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। ১৭ সেপ্টেম্বর মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ নীতি সুদহার দশমিক ৫০ শতাংশ পয়েন্ট কমিয়েছে, যার ফলে স্বর্ণ কেনার প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম বাড়ার ফলে পুরনো অলংকারের দামও বেড়েছে। ৫৪ বছরে স্বর্ণের ভরি ১৫৪ টাকা থেকে বেড়ে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৮ টাকায় পৌঁছেছে, যা ৭০০ গুণ বৃদ্ধি। সাধারণত পুরনো অলংকার বিক্রির সময় জুয়েলার্স স্বর্ণ ওজন করে এবং ক্যারেট অনুযায়ী মূল্য নির্ধারণ করে। সম্প্রতি অলংকারের বর্তমান ওজন থেকে ১৭ শতাংশ বাদ দিয়ে মূল্য নির্ধারণ করা হচ্ছে।
যদি কেউ ২০২০ সালে ৬৯ হাজার ৮৬৭ টাকা ভরিতে কেনা অলংকার বিক্রি করেন, তাহলে বর্তমানে সেটির মূল্য ১ লাখ ১৫ হাজার ১২৭ টাকা হবে। ফলে মুনাফা দাঁড়ায় ৪৫ হাজার ২৬০ টাকা।
স্বর্ণের দাম বেড়ে গেলে জুয়েলারি ব্যবসায়ীদেরও লাভ হয়। উদাহরণস্বরূপ, গত জানুয়ারিতে ২২ ক্যারেটের এক ভরির অলংকার তৈরি করলে তা বিক্রি করলে ২৮ হাজার টাকা বেশি পাওয়া যাবে।
স্বর্ণের চাহিদা দুটি কারণে তৈরি হয়
গয়নার চাহিদা ও স্বর্ণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি। গয়নার জন্য স্বর্ণের চাহিদা বেশি থাকে চীন ও ভারতে, এবং পশ্চিমা দেশগুলোতেও চাহিদা রয়েছে। স্বর্ণের সরবরাহ দুইভাবে হয়: নতুন খনি থেকে উত্তোলন এবং পুরনো স্বর্ণ বিক্রি থেকে।
বাংলাদেশের স্বর্ণের বাজার তুলনামূলক ছোট। দেশে বছরে ২০ থেকে ৪০ টন স্বর্ণের চাহিদা রয়েছে, যার ১০ শতাংশ পুরনো অলংকার দিয়ে মেটানো হয়। বাকিটা বিদেশ থেকে আসে। জুয়েলারি ব্যবসায় স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে স্বর্ণ আমদানির লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল, তবে পরে বিভিন্ন জটিলতায় তা বন্ধ হয়ে যায়।
শীর্ষস্থানীয় ভেনাস জুয়েলার্সের চেয়ারম্যান গঙ্গাচরণ মালাকার জানিয়েছেন, স্বর্ণের দাম বেড়ে যাওয়ায় গয়নার বিক্রি কমে গেছে। বর্তমানে ছোট ও হালকা গয়না বেশি বিক্রি হচ্ছে, কিন্তু পরিমাণের দিক থেকে বিক্রি অর্ধেকে নেমেছে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে সব খাতের ব্যবসা খারাপ হয়েছে, যার প্রভাব জুয়েলারি খাতেও পড়েছে।
স্বর্ণের দাম বৃদ্ধির ফলে অলংকার তৈরির অর্ডারও কমেছে। পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারে স্বর্ণশিল্পীর সংখ্যা কমছে। ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন— দাম বেড়ে যাওয়ায় বিয়েশাদি ছাড়া স্বর্ণের অলংকার আর কেউ কেনে না।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সহ-সভাপতি মাসুদুর রহমান বলেন, দেশে নিত্যপণ্য কিনতে মানুষ হিমশিম খাচ্ছে, অন্যদিকে স্বর্ণের দামও বেশি। সব মিলিয়ে, গত দুই মাসে দেশের জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানের বিক্রি ৬০-৭০ শতাংশ কমে গেছে।
এইউ