২০১৯ সালে রেকর্ড পরিমাণ দর পতন হয়েছিলো চামড়ার। কেনা দামেও চামড়া বিক্রি করতে না পেরে হাজার হাজার চামড়া রাস্তায় ফেলে গিয়েছিলেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। কোরবানি হওয়া পশুর প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ চামড়াই সে বছর নষ্ট হয়েছিলো। তখন থেকেই চামড়া ব্যবসায় আর লাভের মুখ দেখতে পারেননি মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। ফলে এ বছর মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীর সংখ্যা কমেছে।
কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী বনে যেতেন মোহাম্মদ আল আমিন হোসেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের এই বাসিন্দা জানান, গত কয়েক বছর তিনি লোকসান গুনেছেন। ফলে চলতি বছর ঝুঁকি নেননি। লোকসানের ভয়ে কেনেননি কোনো চামড়া।
বিজ্ঞাপন
আল আমিনের মতো অনেকেই এবার সরে দাঁড়িয়েছেন চামড়া ব্যবসা থেকে। যার প্রমাণ মিলেছে রাজধানীর পোস্তায়।

পুরান ঢাকার লালবাগ লাগোয়া পোস্তা এলাকায় কাঁচা চামড়ার আড়ৎ। ঈদের দিন দুপুর থেকে আড়তে আসতে শুরু করে নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা কোরবানির পশুর চামড়া। তবে চামড়া নিয়ে আসা মানুষের মধ্যে সাধারণ মৌসুমি ব্যবসায়ী ছিলেন হাতেগোনা।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও থেকে মৌসুমি ব্যবসায়ী মো. আমির হোসেন এক ট্রাক চামড়া নিয়ে এসেছেন পোস্তায়। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে আমির হোসেন বলেন, দাম ঠিক আছে। ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা পর্যন্ত দাম দিতাছে। সাইজ যেইটা ভালো, সেটা আর একটু বেশি দিতাছে।
বিজ্ঞাপন
লালবাগ এলাকার মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী মো. রায়হান ঢাকা মেইলকে বলেন, এবার আর যাই হোক লোক হচ্ছে না। আমরা গড়ে ৬০০/৭০০ করে চামড়া কিনছি। ৫ লাখ টাকার গরু, সেটার চামড়া কিনছি ৯০০ টাকায়। আড়তে সাড়ে নয়শো করে বিক্রি করা যাচ্ছে। এটা আমাদের জন্য ভালো। গত কয়েক বছর কোনো দাম পাইনি।
তিনি আরও জানান, এ বছর মৌসুমি ব্যবসায়ীর সংখ্যা কম। ভ্যান গাড়ি, পিকআপ ভ্যান ও ট্রাক ভর্তি করে চামড়া নিয়ে আসা ব্যক্তিরা প্রায় সকলেই মৌসুমি ব্যবসায়ী। তবে তাদের প্রায় ৯০ শতাংশই বিভিন্ন মাদরাসা।

রাজধানী ও এর আশপাশের বিভিন্ন এলাকার মাদরাসা থেকে নিয়ে আসা চামড়া একই দামে কিনছেন পোস্তার আড়তদাররা। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের থেকে কেনা চামড়ায় তাৎক্ষণিক দেওয়া হচ্ছে লবণ।
পোস্তার চামড়ার আড়তদার মো. শাহজাহান ঢাকা মেইলকে জানান, এবার অনেক আড়ৎ বন্ধ। যে কটি চালু আছে তারা ভালো দামেই চামড়া কিনেছেন।
এবার সরকারিভাবেও চামড়ার দাম বাড়ানো হয়েছে। লবনযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। যা গত বছর ছিলো ৫০ থেকে ৫৫ টাকা।
সে হিসেবে গত বছরের তুলনায় এবার চামড়া কিনতে বেশি টাকাই খরচ করছেন আড়তদাররা।
বিক্রি হয়নি মাথার চামড়া
গরুর শরীরের চামড়া কিনলেও গরুর মাথার চামড়া কেনেননি পোস্তার ব্যবসায়ীরা। সোমবার (১৭ জুন) ঈদের দিন যারা গরুর শরীরের চামড়া নিয়ে আসেন, তাদের থেকে বিনামূল্যেই মাথার চামড়া রাখেন আড়তদাররা।

জুতা তৈরির কাজে ব্যবহার হলেও মাথার চামড়ার জন্য পয়সা খরচ করতে রাজী নন আড়ৎ মালিকরা।
মৌসুমি ব্যবসায়ী সজিব হোসেন বলেন, গরুর চামড়া নিলো। মাথার চামড়া নিবে না। ফেরত নিয়ে আমরাই বা কি করবো? এমনিতেই দিয়ে আসছি।
ছাগলের চামড়া ১০ টাকা
গরুর চামড়ার ভালো দাম থাকলেও আগের অবস্থানেই রয়ে গেছে ছাগলের চামড়া। গত কয়েক বছরের মতো এবারও ৫ থেকে ১০ টাকায় পাইকাররা নিয়েছেন ছাগলের চামড়া।
এদিন বিকেলে রিকশা চালক আব্দুল হামিদ (৬৫) কে একজন ছাগলের একটি চামড়া দেন। তিনি সেটি বিক্রি করতে আসেন পোস্তায়। একে একে ছয় আড়ৎদারের কাছে যান তিনি। কিন্তু কেউ তার নিয়ে আসা ছাগলের চামড়াটি কিনতে আগ্রহ দেখায়নি। এমনি চামড়াওটি দেখেনওনি কেউ।
শেষমেশ একজন আগ্রহ দেখালে চামড়াটি মাত্র ১০ টাকায় বিক্রি করে যান আব্দুল হামিদ।

ঢাকা মেইলের সঙ্গে আলাপকালে এই রিকশাচালক বলেন, আমার রিকশার এক যাত্রী চামড়াটা দিয়েছে। বিক্রি করতে পোস্তায় নিয়ে এসেছি। কিন্তু কেউ কিনতে চায় না। ছাগলের চামড়ার নাকি দাম নাই। পরে ১০ টাকা দিলো একজন।
শুধুমাত্র হামিদ নয়। ৬টি ছাগলের চামড়া মাত্র ৫০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে দুইজনকে। তাদের একজন মো. রায়হান। ঢাকা মেইলের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, আমরা কিনা আনি নাই। মানুষ দিছে। বিক্রি করতে আনছিলাম। দাম নাই। ৬টা চামড়া ৫০ টাকা দিলো।
ছাগলের চামড়ার দাম নেই কেন? এমন প্রশ্নের ব্যাখ্যা দিলেন ছাগলের চামড়ার আড়তদার মো. শাহজাহান। তিনি বলেন, আগে একেকটা ছাগলের চামড়া ১০০/১৫০ টাকায় বিক্রি হত। কিন্তু এখন কোনো দাম নেই। কেউ কেনে না। ভালো মানের চামড়া হলে ৫/১০ টাকা দিয়ে কিনি। এরপর সেটাকে লবণ দিয়ে প্রসেস করে অল্প দামে বিক্রি করি।
ছাগলের চামড়া নিয়ে কারসাজি
ঈদের দিন পোস্তার ব্যবসায়ীদের কর্মকান্ড অনুসরণ করে দেখায়, ১০ টাকা দরে ছাগলের চামড়া কেনা অধিকাংশ ব্যক্তিই আড়তদার নয়। তারা কিনে রাখা ছাগলের চামড়ার প্রক্রিয়া করা হয় তাৎক্ষণিক। যেখানে চামড়া কেনা হচ্ছে সেখানেই চামড়া থেকে মাংস ছাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে। টুকরো মাংস ছাড়িয়ে নেওয়ার পর তা আবার বিক্রি হয় আড়তে। সেক্ষেত্রে মাংসহীন মাঝারি আকারের একেকটি চামড়া বিক্রি হয় ৩৫ টাকায়। অর্থাৎ শুধু মাংস ছাড়িয়ে একেকটি ছাগলের চামড়ায় লাভ ২৫ টাকা।

৩৫ টাকায় যারা ছাগলের চামড়া কিনছেন, তারা তাতে লবণ দিচ্ছেন। এরপর তা আবার বিক্রি হবে ৭০ থেকে ৯০ টাকায়।
মফস্বলের চিত্র ভিন্ন
রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকায় পাড়া-মহল্লা থেকে মোটামুটি দামে কেনা হয়েছে পশুর চামড়া। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা একেকটি চামড়া পেছনে গুনেছেন ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা। তবে ঢাকার বাইরে পশুর চামড়ার দাম ছিলো আগের অবস্থানেই।
বগুড়ার শারিয়াকান্দি থেকে জানা গেছে, মাঝারি আকারের গরুর চামড়ার জন্য মৌসুমি ব্যবসায়ীরা দিয়েছেন সর্বোচ্চ ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। ছাগলের চামড়ার জন্য এক টাকাও দিতে রাজী ছিলেন না তারা।
স্থানীয় বাসিন্দা আসিফ আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, মৌসুমি ব্যবসায়ী আগের তুলনায় এবার কম। যারাও এসেছে, দাম কম বলে। দেড় লাখ টাকার গরুর চামড়ার দাম বলে দেড়শো টাকা, ২০০ টাকা। দুই লাখ টাকার গরুর চামড়া ৩০০ টাকা! ছাগলের চামড়া নিবেই না। পরে আর বিক্রি করা হয়নি। সব একত্রে মাদরাসায় দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কারই/এমএইচএম

