কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনকে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্দেশে তিনি বলেন, ভেবেচিন্তে গভীরে গিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত নেবেন। এই সিদ্ধান্তে অটল থাকবেন। না হলে ব্যবসায়ীদের আস্থা থাকবে না কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর।
বৃহস্পতিবার (১৬ মে) রাতে রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে ‘কেমন বাজেট চাই’ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
বিজ্ঞাপন
গত দেড় দশক ধরে প্রচারিত হচ্ছে বাজেট নিয়ে এনটিভির এই আলোচিত অনুষ্ঠানটি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত যেমন সংসদে রেকর্ড সংখ্যকবার বাজেট উপস্থাপন করেছেন, তেমনি এনটিভির এই আয়োজনেও প্রধান আলোচক হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন টানা ১০ বার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর বলেন, ‘ব্যাংক সম্পর্কে স্বল্প পরিসরে বলা যাবে না। তবে সরকারি বাজেট এবং যেকোনো কোম্পানির বাজেটের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। সরকারি বাজেট সরকারের আয়-ব্যয় ছাড়াও প্রাইভেট সেক্টর এবং ব্যক্তিগত সেক্টরে ইফেক্ট ফেলবে। এই দৃষ্টিতে কিন্তু বাজেটটা দেখতে হবে। মূল চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে এখন মানুষের জীবিকার সংগ্রাম আসতে আসতে পলিসি মেকারদের আড়ালে চলে যাচ্ছে। ইনফ্লেশন নিয়ে কথা হচ্ছে, ইনফ্লেশন না এটা সামাজিক উন্নয়নের ব্যাপাটা আসছে।’
ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বাজেটে সামাজিক উন্নয়ন ও মূল্যস্ফীতিকে গুরুত্ব দিতে হবে। কয়েকটা বড় ইন্ডাস্ট্রি ছাড়া আমাদের ওইরকম বড় শিল্প গড়ে ওঠেনি। আমরা হংকং হতে পারব না, সিঙ্গাপুরও হতে পারব না। সুতরাং সার্ভিস সেক্টর আমরা এগোতে পারবো না। সুতরাং আমাদের শিল্প খাতকে গুরুত্ব দিতে হবে। ছোট ও মাজারের শিল্পকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। যেখান থেকে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বাজেটের পলিসি হতে হবে জনবান্ধব এবং শিল্পবান্ধব।’
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘আমার বক্তব্য হচ্ছে শিল্পের পথের কাঁটাগুলোকে সরিয়ে দিতে হবে। কেউ যদি শিল্প প্রতিষ্ঠান করতে যায় তাকে প্রতিষ্ঠান গড়া সহজ করে দিতে হবে। আমাদের এখানে প্রতিটি ঘরে প্রতিটি চেয়ারে এবং প্রতি টেবিলে টাকা দিতে হয়। তাই বিদেশি বিনিয়োগ আসে না। বিদেশি বিনিয়োগ আনতে হলে এই অবস্থার উন্নতি করতে হবে।’
বিজ্ঞাপন
সালেহউদ্দিন বলেন, ‘ব্যাংক খাতের সমস্যাগুলো অজানা নয়। আর সমাধানও অজানা নয়। সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আরও শক্ত হতে হবে এবং আরও কঠোর হতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা। আজকে এক সিদ্ধান্ত আবার কয়েক দিন পর আরেক সিদ্ধান্ত। এর থেকে উত্তরণ করতে হলে ভেবেচিন্তে গভীরে গিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত নেবেন। এবং এই সিদ্ধান্তে অটল থাকবেন। না হলে ব্যবসায়ীদের আস্থা থাকবে না কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর। বাজারেরও আস্থা থাকবে না। এতে সবকিছুই লাগাম ছাড়া হয়ে পড়বে। এজন্য মুদ্রানীতি এবং রাজস্ব নীতির সমন্বয়ের বিকল্প নেই।’
‘২০২১-২২ এ আমাদের চাহিদা থাকার পরও টাকার দর ধরে রাখা হয়েছিল। এতে আমাদের ক্ষতি হয়েছে। টাকার দর এখন একসাথে অবমূল্যায়ন করতে হয়েছে। তাহলে আমাদের ১২ বিলিয়ন ডলার খরচ করে লাভটা হলো কী? এটা কি ভালো ডিসিশন ছিল? মোটেও না। আমার মনে হয় যারা পলিসি মেকার তাদের এই বিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে।’
অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমাদের যে বাজেট দেওয়া হয় তার মধ্যে ৬০ ভাগই অবকাঠামো ও যোগাযোগব্যবস্থার ওপর বরাদ্দ রাখা হয়। যেখানে ৩০ শতাংশই অতি মূল্যায়িত হয়। আওয়ামী লীগের ইশতেহার ও এসডিজি লক্ষ্যমাত্রায় স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে যে বরাদ্দ রাখার কথা হয়েছিল তা অর্ধেকও বাস্তবায়ন হয়নি। এক কথায় সরকার মুখে যেটা বলে সার্বিকভাবে অনেক ক্ষেত্রেই তা বাস্তবায়িত হয় না।’
দেবপ্রিয় বলেন, ‘বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা জবাবদিহিতা। আমাদের কোনো ক্ষেত্রেই জবাব দিতে নাই। তাই জবাবদিহিতা দরকার। একদিকে ট্যাক্স দেব না, একচেঞ্জ রেট ঠিক করব না, সুদের হার ঠিক করব না, কিন্তু দুবাইতে ৩৪৯ জনের সম্পদ বাড়বে। এজন্য তো ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন করিনি।’
তার মতে- ‘এ মুহূর্তে সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে দেশ। আমাদের অর্থনীতিতে এ মুহূর্তে আরও এক বড় সমস্যা হলো প্রকৃতিতে মন্দা দেখা দিয়েছে। সরকারের অর্থনীতিতে সমস্যা হলো রাজস্ব বাড়েনি। এ মুহূর্তে সরকারের খরচ বাড়ানোর কোনো অবস্থা নেই। বিদেশি ঋণ শোধ করার মতো অবস্থা নেই।’
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘আমাদের রাজনীতি যদি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি তাহলে শরীরে অন্যান্য জায়গায় সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। গতবার থেকে এবার কী এসেছে। আপনারা যদি দেখেন গত ১০ বছরে আমরা ব্যক্তি পর্যায়ে রাজস্ব সেভাবে বাড়েনি। আজকে যদি করোনার কথা বলেন, তাহলে অর্থনীতির বিবেচনা ঠিক হলো না।’
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘গতবার আমি যখন আলোচনা করেছি তখন আমি বলেছি এবং যা কথাগুলো বলবো আইএমএফআইয়ের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে, আমাদের সাথে অনেক সময় আইএমএফআইয়ের সাথে মিলবে না, কিন্তু আমাদের দেশের অর্থনীতিবিদের মধ্যে আমরা মোটামুটি একটা ঐক্যমতে এসেছি। সেটা হলো মূল্যস্ফীতি ও সমষ্টিক অর্থনীতির। এটা আমরা যেভাবে বলি না কেন, এটা বিনিময় হার দিয়ে বলি, পণ্য মূল্য দিয়ে বলি অথবা সুদের হার দিয়ে বলি। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতীশীলতা ১ নম্বর বিষয় হিসেবে সবার কাছে প্রতিপালিত হবে। কারণ এটা অনেকটা শরীরে ডায়েবেটিকের মতো।’
এ সময় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান বলেন, ‘আসন্ন ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটকে জনবান্ধব করতে স্টেকহোল্ডারদের দেওয়া প্রস্তাবনাগুলো বিবেচনায় নেওয়া হবে। পাশাপাশি বাজেট বাস্তবায়নে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থাগুলোতে সক্ষমতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতি ইঙ্গিত করে ড. মশিউর রহমান বলেন, ‘আমরা সামাজিক সুরক্ষাসহ দেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি ও উন্নতির লক্ষ্যে পদক্ষেপের কথা থাকবে আসন্ন বাজেট প্রস্তাবনায়। বাজেট তৈরির আগে বিভিন্ন মহল থেকে অনেক প্রস্তাবনা আসে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ চিন্তাভাবনা থেকে এসব প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। রাজস্ব আয় বাড়িয়ে অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
এনবিআরের নানা ধরনের হয়রানির বর্ণনা দিয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘দেশে অর্থনৈতিক অবস্থা করুণ। সরকার এনবিআরকে রাজস্ব বাড়াতে চাপ দিচ্ছে। আর এনবিআর নানা ফন্দি করে ব্যবসায়ীদের গলা কাটছে।’
অর্থপ্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, ‘আমরা বঙ্গবন্ধুর কৃষি বিপ্লবকে সামনে রেখে একটি পলিসি নির্ধারণ করবো, যাতে দেশের তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ উপকৃত হয়। একই সঙ্গে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতিতে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা থাকবে আসন্ন বাজেটে।’
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকার সমস্যা দূর করার জন্য সরকারের নেওয়া লক্ষ্য ও কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের নির্দেশনাও থাকবে আসন্ন বাজেট প্রস্তাবনায়।’
টিএই/জেবি