শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি: মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস

হাবীব ইমন
প্রকাশিত: ১৪ মে ২০২২, ০৯:১৬ এএম

শেয়ার করুন:

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি: মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস

অভাব ও দারিদ্র্যের কষাঘাতে আজকের জনজীবন দুঃখ ও হাহাকারে পূর্ণ। মানুষের ওপর চেপে বসেছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ঘোটক। জীবনধারণের উপযোগী প্রতিটি জিনিসের অগ্নিমূল্য। চাল, ডাল, মাছ, মাংস, তেল, তরিতরকারি, ফলমূল, চিনি, লবণ, গম, আটা, রুটি, বিস্কুট ইত্যাদি দ্রব্যের মূল্য আগের তুলনায় কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে।

একদিকে করোনার প্রভাবে কর্মহীন মানুষ, অন্যদিকে বন্যায় সবজিতে ব্যাপক ক্ষতি। সব মিলিয়ে কাঁচাবাজারের লাগামহীন মূল্যে নিম্ন আর মধ্যম আয়ের মানুষের জীবন এখন বিপর্যস্ত। 


বিজ্ঞাপন


মধ্যবিত্তের কথা
শাহাদাত হোসেন শিবলী। মতিঝিলে একটি ব্যাংকে মাঝারি মানের পোস্টে কাজ করেন। ভরদুপুরে রুটি-কলা খাচ্ছিলেন তিনি। দুপুরে ভাত না খেয়ে রুটি-কলা কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন সাধারণ রেস্তোরাঁগুলোতে এক বেলা সবজি, ডাল ও ভাত খেতেও ৮০ টাকা লেগে যায়। সংসারের খরচ বেড়ে যাওয়ায় তিনি দুপুরে রুটি-কলা খেয়ে কাটানো শুরু করেছেন।

জানতে চাইলে, শিবলী সংসারে ব্যয় বাড়ার খতিয়ান তুলে ধরেন। বলেন, গত মাসে তার বাসাভাড়া ৫০০ টাকা বেড়েছে। সন্তানের স্কুলে যাওয়া-আসার জন্য দিনে রিকশাভাড়া লাগত ২০ টাকা করে ৪০ টাকা। এখন লাগে ৬০ টাকা। চাল, ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজসহ সব পণ্যের দামই বাড়তি। অফিসে যাওয়া-আসা করতেও বাসভাড়া বেশি দিতে হচ্ছে। কিন্তু তার আয় দুই বছর আগে যা ছিল, এখনও তা-ই আছে। সংসার চালাতে এখন প্রতি মাসেই ধারকর্জ করে চলতে হচ্ছে।

শিবলীর মতো সাধারণ মানুষের সংসারে ব্যয়ের বড় খাত চারটি—খাদ্য ও ঘরকন্নার উপকরণ কেনা, বাসাভাড়া ও সেবার বিল, সন্তানদের পড়াশোনা এবং পরিবহন। দেশে এই চারটি খাতেই একসঙ্গে পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়ে যাওয়ায় হিমশিম অবস্থা মানুষের।

বাজারে এখন তেলের দাম চড়া। সাম্প্রতিককালে চাল, ডাল, চিনির দাম বেড়েছে ব্যাপকভাবে। বেড়েছে সংসারে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের দাম। ডিজেলের দাম বাড়ানোর পর পরিবহন ভাড়া এক লাফে বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। করোনার কারণে না বাড়ালেও এ বছর বাড়ির মালিকেরা বাসাভাড়া বাড়িয়েছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্কুল-কলেজের বেতন ও খাতা-কলমের দামও বাড়তি।


বিজ্ঞাপন


শাহাদাত হোসেন শিবলী বলেন, সীমিত আয়ের মানুষ খুব কষ্টে আছে। ধনীদের কথা আলাদা।

কতটা বেড়েছে দাম
আওয়ামী লীগ সরকার এই মেয়াদে দায়িত্ব নিয়েছিল ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ওই দিনের বাজারদরের তালিকা ও গত বৃহস্পতিবারের তালিকা ধরে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মোটা চালের দাম ৯, মোটা দানার মসুর ডাল ৭৫, খোলা সয়াবিন তেল ১২৯ ও আটার দাম ৩৩ শতাংশ বেড়েছে।

শুধু ভোজ্যতেলের কথা ধরা যাক। মধ্যম আয়ের পাঁচজনের একটি পরিবারে গড়পড়তা ৫ লিটার সয়াবিন তেল লাগে। টিসিবির হিসাবে, ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি ৫ লিটারের এক বোতল সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৪৬৫ থেকে ৫১০ টাকা, এখন তা ৯৭০ থেকে ৯৯০ টাকা। কোথাও কোথাও তারও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। মানে হলো, শুধু সয়াবিন তেল কিনতে একটি পরিবারের ব্যয় বেড়েছে ১২০ শতাংশ।

কাঁচাবাজারে মাছ, মাংস ও সবজির দাম নিয়মিত ওঠানামা করে। তবে বিগত এক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, ফার্মে উৎপাদিত মুরগির দাম বছরজুড়েই বেশি থাকছে। যেমন ব্রয়লার মুরগির দাম এখন বছরের বেশির ভাগ সময় প্রতি কেজি ১৫০ টাকার বেশি থাকে। করোনার আগেও এই দর ১২৫-১৩০ টাকার আশপাশে থাকত। বিক্রেতাদের দাবি, মুরগির বাচ্চা, খাবারের দাম ও পরিবহন ব্যয় বেড়ে গেছে। তাই আর আগের দামে ফেরার আশা কম।

সীমিত আয়ের পরিবার কালেভদ্রে এখন গরুর মাংস কিনতে পারে। এখন বাজারে গরুর মাংসের কেজি ৭০০ টাকা। তিন বছর আগে এই সময়ে ছিল ৫০০ টাকার নিচে।

রমজানের শুরুতেই বাজারে প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম এক দফা বেড়েছিল। পুরো রমজানে মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যায়। এই ধাক্কা সামলানোর আগেই এখন নতুন করে বাজারে বিভিন্ন মুদিদোকান ও কাঁচাবাজারের খাদ্যপণ্য নয় শুধু, বেড়েছে নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দামও। ঈদের পর গত এক সপ্তাহে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে পেঁয়াজ, মসুর ডাল, চিনি, আটা, ময়দা, ডিমসহ অন্যান্য জিনিসের দাম বেড়েছে।  

ঢাকার খিলগাঁওয়ের তালতলা সিটি করপোরেশন মার্কেটের ‘কাজল ট্রেডার্স’ নামে একটি মুদিদোকানের মালিক কাজল মিয়া  বলেন, ঈদের আগে এতো দাম ছিল না, ঈদের দুইদিন পরে সব দাম বেড়ে চলেছে। এক বক্স টিস্যু পেপারের দাম ১০ টাকা বেড়েছে। ৯০ টাকায় এক কেজি গুঁড়া সাবান পাওয়া যেত। এখন তা ১০৫-১১০ টাকা। বেড়েছে অন্যান্য জিনিসের দামও।

কথা হয় ‘খুশি ট্রেডার্স’ এর মালিক খুশি আপার সাথে। তিনি জানান, ঈদের আগে পেঁয়াজ বিক্রি করছি ২৫ টাকায়, এখন এটা ৪৫ টাকায় বিক্রি করছি। ডিম বিক্রি করছি হালিতে ৩৬ টাকা, এখন ৪০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। 

মেসার্স তালতলা ট্রেডার্র এর রকিব উদ্দিন বলেন, সব জিনিসপত্রের দাম বাড়তি। শুক্রবারে মানুষের ঢল নামতো এ মার্কেট, এখন একদমই মানুষ নাই। মানুষের কেমনে কিনবে, মানুষের হাতে টাকা নাই। আর আমাদের মতো ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা খারাপ। 

শিক্ষা উপকরণের দাম কতটা বেড়েছে, তা তুলে ধরেন ঢাকার মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়া মহিলা মহাবিদ্যালয়সংলগ্ন ‘কলেজ লাইব্রেরি’ নামের একটি দোকানের বিক্রেতা আজিজুর রহমান। তিনি বলেন, একটি খাতার দাম ২০ থেকে বেড়ে এখন ২৫ টাকা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে পেনসিলের দাম। ১০ টাকার একটি পেনসিলের দাম ২ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে।

যাদের বাড়িতে সরকারি কোম্পানির গ্যাসলাইন নেই, তারা বিপাকে আছেন সবচেয়ে বেশি। ২০২১ সালের শুরুতে যে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস সিলিন্ডার (১২ কেজি) ৮০০-৮২০ টাকা ছিল, তা এখন সাড়ে পনের শ টাকা।

oil

তেলের তেলেসমাতি
করোনার ধাক্কায় গোটা বিশ্বের অর্থনীতি ও বাজার ব্যবস্থা টালমাটাল। স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশের পরিস্থিতিও ভিন্ন হওয়ার কিছু নয়। যেহেতু অধিকাংশ নিত্যপণ্যের জন্য আমদানির ওপর আমাদের নির্ভর করতে হয়। ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির আগুনে পুড়তেই হচ্ছে মানুষকে। সেই আগুনে ঘি ঢালল ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতি। এরপরেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। যেমন, ধানের উৎপাদন ভালো হয়েছে, মজুতও যথেষ্ট পরিমাণে আছে ফলে কোনো ঘাটতি হওয়ার কথা নয়; তাহলে চাল কিনতে কেন সাধারণ মানুষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে? সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন এর উত্তর হতে পারে দুইটি—হয় উৎপাদন ও মজুদ নিয়ে সরকার সঠিক তথ্য দেয়নি, বাড়তি পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে অথবা বাজারে সিন্ডিকেট করে এই অস্থিরতা তৈরি করা হয়েছে। 

সরকারের এক মন্ত্রী তো বলেই দিলেন, বিএনপির ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দিয়েছেন। কথা হচ্ছে, বিএনপি যেখানে মিছিল-সমাবেশ করতে রাস্তাতেই নামতে পারে না, সেখানে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দিয়ে গোটা দেশে অস্থিরতা তৈরি করে দিয়ে এত বড় ‘সাফল্য’ দেখিয়ে ফেলল! 

আবার আরেক মন্ত্রী বলছেন, প্রধানমন্ত্রী নিজেই বাজার পরিস্থিতি মনিটর করছেন। মন্ত্রীদের এসব বক্তব্য নিয়ে তার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, কোথায় তারা মানুষকে আশ্বস্ত করবেন, উল্টো এসব কথাবার্তা বলে বিভ্রান্ত করছেন!  

শুক্র ও শনিবার রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেট ঘুরে দেখা যায়, অনেক দোকানে ১ লিটারের সয়াবিন তেল নেই।  একেক সময় একেক পণ্য বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়। কখনো লবণ, কখনো চিনি, কখনো পেঁয়াজ। যেন পালা করে একেক পণ্যের ব্যবসায়ীরা ‘সমঝোতা’ করে নেন বা তাদের সুযোগ করে দেওয়া হয়। একেকবার একেক পণ্যের নামে লুট হয়ে যায়, খালি হয়ে যায় মধ্যবিত্তের সঞ্চয়। লোপাটের এই মিউজিক্যাল চেয়ার খেলায় এবার কি ভোজ্যতেলের ব্যবসায়ীদের পালা?

করোনায় বিপর্যস্ত, দ্রব্যমূল্যে নাকাল
ব্যয়ের সব খাতে এই চাপ এমন একটা সময় পড়েছে, যখন করোনার কারণে দেশের মানুষের একটি অংশ অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত। তাদের মতো একজন শেরপুরের শওকত ঢাকার রাস্তায় রাইড শেয়ারিংয়ে মোটরসাইকেল চালান। বৃহস্পতিবার নতুন বাজার মোড়ে যাত্রীর অপেক্ষায় ছিলেন তিনি।
জানতে চাইলে শওকত বলেন, শেরপুরে তার দোকান ছিল। কয়েকজন কর্মচারীও ছিল। কিন্তু করোনার প্রথম বছরেই লাখ দুয়েক টাকা দেনা হয়ে যায়। উপায় না দেখে কর্মচারীদের বিদায় করে নিজে ঢাকায় এসে মোটরসাইকেল চালানো শুরু করেন।

তিনি আরও বলেন, তার বাসাভাড়া ৫০০ টাকা বাড়িয়ে ৯ হাজার টাকা করা হয়েছে। বাজারের যা অবস্থা, তাতে দিনে এক হাজার টাকা আয় না করতে পারলে চলা যায় না। দেনা শোধ করবেন বলে ঢাকা এসেছিলেন। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। উল্টো সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মোটরসাইকেল চালিয়ে পিঠে (মেরুদণ্ডে) ব্যথার রোগে ধরেছে।

করোনাকালে নতুন দারিদ্র্য বেড়েছে বলে বিশ্লেষণ ও জরিপের মাধ্যমে দেখিয়েছে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস), পিপিআরসি ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)। সানেম বলেছিল, দারিদ্র্যের হার ২১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য সরকার এই দাবি নাকচ করে দিয়েছে। যদিও সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কোনো জরিপ বা বিশ্লেষণ তুলে ধরেনি। ২০২০ সালের অক্টোবরে এক জরিপে তারা মানুষের আয় ২০ শতাংশ কমে যাওয়ার তথ্য জানিয়েছিল।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য বলছে, ৪ কোটি ৮২ লাখ মানুষ প্রকৃত বেকার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের শ্রমশক্তির বাইরে ছিল ৪ কোটি ৬৬ লাখ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার। বেকারত্বের কারণে ৭৮ লাখ বাংলাদেশী বর্তমানে বিদেশে কর্মরত। আর দেশে উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে শতকরা ৪৭ ভাগ বেকার।

Tcb

টিসিবি লাইনে মধ্যবিত্তের দীর্ঘশ্বাস
বেলা প্রায় ১১টা। ঢাকার মালিবাগ মোড়ে রাস্তার পাশে নিত্যপণ্যবোঝাই একটি ট্রাক দাঁড়ানো, তার পেছনে শতাধিক মানুষের লাইন। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাক থেকে ন্যায্যমূল্যে বাজার করতে অপেক্ষারত লাইনের মানুষেরা। ট্রাক আসার আগে প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে অপেক্ষা করছেন তারা।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নিম্ন আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস দশা। ভর্তুকি মূল্যে বিক্রি হওয়া ১৯২ টাকা লিটার তেল, ১০৫ টাকা কেজি মসুর ডাল কিনতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে এখানে। তবু নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তের কাছে এ-ই যেন এক বড় সুযোগ।

ঘণ্টাখানেক লাইনে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে রাস্তার পাশে বসে পড়েছেন ষাটোর্ধ্ব মোখলেসুর রহমান। তার এক ছেলে ছোটখাটো ব্যবসা করেন, আরেক ছেলে বছরখানেক ধরে সৌদি আরব থাকেন। দুই ছেলের আয়েও স্বস্তিতে দিন কাটানোর উপায় নেই তার মধ্যবিত্ত পরিবারে। তাই বাজার থেকে একটু কম দামে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর খোঁজে এসেছেন টিসিবির লাইনে।

মোখলেসুর রহমান বলেন, ‘জিনিসপত্রের যে দাম, বাজার থেকে রেগুলার কিনতে সংসার খরচে টানাটানি হয়। বাজারে সয়াবিন তেলের লিটার ২২০ টাকা করে, টিসিবির ট্রাকে ১৯২ টাকা লিটার তেল পাই। চিনি, মসুর ডাল, বাজার থেকে কম দামে দিচ্ছে।’

লাইনে দাঁড়িয়ে গরমে হাঁসফাঁস করলেও জায়গা ছাড়ছিলেন না ফুটপাতের ব্যবসায়ী স্বপন মিয়া। তিনি বলেন, ‘মাত্র জিনিসগুলা মাপামাপি করতেছে। মাপা শেষ কইরা দেওয়া শুরু করতে আরও কমপক্ষে দুই ঘণ্টা সময় লাগব। এই লাইনের মানুষদের দিতে দিতেই বিকাল হইব। তবুও কষ্ট কইরা আসছি যখন মাল না নিয়া যামু না আইজ।’

দুপুর গড়ানোর সাথে সাথে টিসিবির লাইন আরও বড় হতে থাকে। বিক্রি শুরু হয় সাড়ে ১২টার দিকে। নারীদের লাইনে শেষের দিকে দাঁড়ানো গৃহিণী ফাতেমা শঙ্কা নিয়ে বলেন, ‘আজকে লাইনে দাঁড়াতে দেরি হয়ে গেছে। তাই ভয়ে আছি জিনিস কিনতে পারব কি না। আমার স্বামী গার্মেন্টেসে কাজ করেন। তার স্বল্প আয়ে সংসার চালাতে খুব কষ্ট হয়ে যায়। মাসের শেষে এখন ধার করে চলতে হচ্ছে।’

সরকারের কি কিছু করার আছে
এই দফায় সব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধি। সরকারের পক্ষ থেকে এই যুক্তি বারবার তুলে ধরা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরাও বলছেন, বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি জাহাজভাড়া বেড়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হওয়ায় আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, সরকারের কি কিছু করার ছিল?

অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা বলছেন, সরকারের কাছে বাজার নিয়ন্ত্রণের উপায় ৩ টি: ১. করছাড়, ২. খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি বাড়ানো ও ৩. বাজার তদারকি। 

জাতিসংঘ উন্নয়ন প্রোগ্রাম বা ইউএনডিপি বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকোনোমিস্ট অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, আমাদের তো চালের উৎপাদন ভালো হয়েছে, তাহলে তো চালের দাম বাড়ার কথা না। তেলের দাম না হয় বুঝলাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে বেড়েছে। আসলে আমাদের ৫০-৬০টি চালকল এত বড় তারাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে৷ এটাকে আমি সিন্ডিকেট বলব না৷ ধানের বড় একটা অংশ তারা ভাঙায়, ফলে তারা যে দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে সেটাতেই বিক্রি হচ্ছে৷ এখানে সরকারকে ভূমিকা রাখতে হবে৷ কতিপয় মানুষের কাছে বাজারের নিয়ন্ত্রণ চলে গেলে তারা তো মুনাফা করতে চাইবেই। পাশাপাশি তেলে দাম বৃদ্ধির কারণে পরিবহন খরচও বেড়ে গেছে৷

এর সঙ্গে টিসিবির সক্ষমতা বাড়িয়ে আরও বেশি পণ্য দিয়ে তাদের মাঠে নামানোর কথাও বলছেন এই অর্থনীতিবিদ।

গত নভেম্বরে ডিজেলের দাম এক লাফে ১৫ টাকা বাড়িয়ে দেয় সরকার। কৌশলগত পণ্যের ওপর প্রায় ৩৪ শতাংশ কর রয়েছে। সেখানে কোনো ছাড় দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে ‘সিটিং সার্ভিসে’র নামে বেশি ভাড়া আদায়, নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি নেওয়াও বন্ধ হয়নি বলে অভিযোগ করছেন যাত্রীরা। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) মালিকদের প্রস্তাব যাচাই-বাছাই ছাড়াই লঞ্চভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে। মানুষকে ৩৫ থেকে ৪৬ শতাংশ বেশি ভাড়া দিয়ে লঞ্চে চড়তে হচ্ছে।

সরকার গত আগস্টে চাল আমদানির উদ্দেশ্যে আগাম অনুমতি সাপেক্ষে শুল্ককর ৬২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করে। তবে শর্তের কারণে চাল আমদানি তেমন একটা হয়নি। দামও কমেনি।

মানুষের দুর্দশার মধ্যে দাম কমাতে খুব একটা উদ্যোগ না থাকলেও বাড়াতে তৎপর সরকারি সংস্থাগুলো। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) ইতিমধ্যে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ঢাকা ওয়াসাও পানির দাম বাড়াতে চায়।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সবার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে৷ যারা বাজারে গিয়ে নিজেদের অসহায় মনে করে, তাদের সবাইকে সোচ্চার হতে হবে৷ নতুবা সরকার শুনবে না৷ আমরা তো প্রতিদিনই এগুলো নিয়ে চিৎকার করছি, কিন্তু কেউ আমাদের কথা শুনছে না৷ জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কয়দিন পর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দাবি তুলবেন তাদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর জন্য৷ সরকার হয়তো তাই-ই করবে৷ সাধারণ মানুষের তো আয় বাড়ছে না৷ কষ্টটা তাদেরই বেশি হবে৷ সে জন্য নিত্যপণ্যের বাজারে এখনই লাগাম টানতে হবে৷ সরকার চাইলেই টিসিবির পরিধিও আরও বাড়াতে পারে, কিন্তু সেটাও তারা করছে না৷

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, অনুনয়-বিনয় করে ব্যবসায়ীদের মন গলানো যাবে না। বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। 

তিনি মনে করেন, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে তেলসহ নিত্যপণ্যের আমদানি ও মজুদ গড়ে তোলা, টিসিবির গাড়ির সংখ্যা বাড়ানো, অন্তত ৩ কোটি পরিবারকে তেলসহ নিত্যপণ্য সরবরাহ করা দরকার। 

রুহিন হোসেন প্রিন্স অভিযোগ করেন, পরিস্থিতিটাকে গুরুত্ব না দিয়ে সরকারের মন্ত্রীদের অনেকে এনিয়ে উপহাস করছেন।

তিনি বলেন, মন্ত্রীদের কেউ বলছেন, জিনিসপত্রের দাম বাড়লে কী হবে-মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। আবার কেউ বলছেন, মানুষ না খেয়ে নাই। এ ধরনের উপহাস মন্ত্রীরা করছেন।

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির পরিস্থিতি এখন দেশটির রাজনীতিতে বড় ইস্যু হয়ে উঠেছে। বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এই পরিস্থিতির জন্য সরকারকে দায়ী করছে। বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেছেন, ভোজ্য তেল, চাল-ডালসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির অস্বাভাবিক পরিস্থিতিকে সরকার স্বীকার করছে না এবং সে কারণে সংকট বাড়ছে।

গণমাধ্যমে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ভোজ্যতেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেলেও রাজনৈতিক চিন্তা থেকে সরকার পরিস্থিতিটাকে স্বীকার করছে না। সংকটটাকে স্বীকার না করা-এটা বড় সমস্যা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জোবায়দা নাসরিন বলেন, যেহেতু সাধারণ মানুষ ভূক্তভোগী এবং সমাজে দাপটে মধ্যবিত্তকেও আঘাত করছে। সেকারণে এটি বড় আকারে রাজনৈতিক ইস্যু হতে পারে। যদি সরকার এখনই নজর না দেয়।

কৃষি মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড: আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, তারা সমস্যাটিকে গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছেন। তবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সরকারের ব্যর্থতা বা সিন্ডিকেটের তৎপরতার যে সব অভিযোগ করেছে. মন্ত্রী ড: রাজ্জাক এসব অভিযোগ নাকচ করে দেন।

আগামী কয়েক দিনের মধ্যে বাজারে তেলের সংকট কেটে যাবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। সম্প্রতি গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলে তার প্রভাব আমাদের বাজারেও পড়বে। তখন তেলের দাম কমবে।

এইচই / একেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর