সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে দেশে প্রথমবারের মতো চালু হয়েছে সর্বজনীন পেনশন সুবিধা। আপাতত চার ক্যাটাগরিতে চালু করা হয়েছে এই স্কিম। সরকারের নেওয়া এমন পদক্ষেপকে অর্থনীতিবিদ ও বিশিষ্টজনরা প্রাথমিকভাবে স্বাগত জানালেও এর বাস্তবায়ন নিয়ে অনেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তাদের মতে, উদ্যোগটি ভালো হলেও এর প্রস্তুতি ও নিরাপত্তায় চ্যালেঞ্জ আছে। সর্বজনীন পেনশন সুবিধায় যেন হয়রানির শিকার হতে না হয়, তা নিশ্চিতের পাশাপাশি স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তার বিষয়গুলোকে আরও স্পষ্ট করার আহ্বান জানান তারা।
সর্বস্তরের মানুষকে সুবিধা দেওয়ার চিন্তা মাথায় রেখে গত বৃহস্পতিবার সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এর উদ্বোধন করেন। এই স্কিমের আওতায় সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া দেশের সকল নাগরিক পেনশন সুবিধার অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। অর্থাৎ কারও বয়স ১৮ বছরের বেশি হলেই অনলাইনে নিবন্ধন করতে পারবেন। ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত পেনশন স্কিম খোলা যাবে। কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দিলে এই সুবিধা পাওয়া যাবে। যাদের বয়স ৫০ বছরের বেশি, তারাও এর আওতায় আসবেন। তবে শর্ত হলো তাদের ১০ বছর চাঁদা পূর্ণ করতে হবে। ৬০ বছরের পর থেকে পেনশন পাওয়া যাবে।
বিজ্ঞাপন
ছয়টি স্কিমের মধ্যে চারটি স্কিম উদ্বোধন করা হলেও বাকি দুটি পরে চালু করা হবে। চালু করা চারটি স্কিমের মধ্যে ‘প্রবাস’ স্কিমটি প্রবাসীদের জন্য। ‘প্রগতি’ স্কিম চালু করা হয়েছে বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য। অনানুষ্ঠানিক খাত অর্থাৎ স্বকর্মে নিয়োজিত নাগরিকদের জন্য রয়েছে ‘সুরক্ষা’ স্কিম। আর ‘সমতা’ স্কিমটি নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য। এই চার স্কিমে ১৮ বছরের বেশি বয়সী ১০ কোটি মানুষ অংশ নেবে বলে আশা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, যে দুটি পরে চালু করা হবে তার মধ্যে একটি শ্রমিক শ্রেণির জন্য, অন্যটি শিক্ষার্থীদের জন্য।
কোনো নাগরিক পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হলে ৬০ বছর বয়সের পর থেকে আজীবন পেনশন সুবিধা পাবেন। গ্রাহক মারা গেলে তার নমিনি বা উত্তরাধিকারী পেনশন পাবেন। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকের ৭৫ বছর বয়স হতে যত বছর বাকি থাকবে, সেই সময় পর্যন্ত নমিনি পেনশন তুলতে পারবেন। ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী যে কেউ পেনশন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। ৫০ বছরের বেশি বয়সীরাও বিশেষ বিবেচনায় পেনশনভুক্ত হতে পারবেন। তবে আজীবন বা ন্যূনতম ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত পেনশন সুবিধা পেতে কমপক্ষে একাধারে ১০ বছর নির্দিষ্ট হারে চাঁদা পরিশোধ করতে হবে। আর্থিক কার্যক্রম আপাতত সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে পরিচালনা করা হবে।
বিজ্ঞাপন
সবার জন্য পেনশনের সুবিধা দিতে সরকারের নেওয়া এমন পদক্ষেপকে স্বাগত জানালেও এর বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ দেখছেন কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে এটি ভালো উদ্যোগ। তবে বিষয় হচ্ছে যে টাকাগুলো আমি দেব, যাকে দেব সে এটাকে যদি সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা না করতে পারে তাহলে যখন আমার পাওয়ার সময় হবে তখন আমি এই টাকাটা পাব কি না। এর যে বেনিফিট ভবিষ্যতে দেওয়া হবে সেটা পাওয়ার জন্য বর্তমানে যেটা আপনি সঞ্চয় করবেন এটা ফাইন্যান্সিয়াল দৃষ্টিকোণ থেকে বেশ আকর্ষণীয়। তারপরেও এই সুযোগটা আমি নিতে চাইব কি চাইব না, তা নির্ভর করছে আমি কতটা ভরসা পাচ্ছি তার ওপর। সেখানে কর্তৃপক্ষের বিষয়টা চলে আসছে। বিষয় হচ্ছে যে, ফান্ড ম্যানেজমেন্টটা কারা করবে। দক্ষ জনবল আছে কি না।’
জাহিদ হোসেন আরও বলেন, ‘এখানে সেই ধরনের লোকবল দরকার হবে যারা ফান্ড ম্যানেজমেন্টে পারদর্শী। তারা এটাকে দক্ষতার সঙ্গে ম্যানেজমেন্ট করবে যাতে ঝুঁকিটা একেবারে কমে যায়। এখানে দুটো বিষয় আছে প্রথমত আপনি সেখান থেকে রিটার্নটা কত পাবেন, আরেকটা বিষয় হচ্ছে যে ঝুঁকিটা কত। এখানে যদি এমনভাবে ফান্ডটা গঠন করা হয় যেখানে একটাতে রিটার্ন যদি কমে যায় আরেকটা রিটার্ন বেড়ে যাবে তাহলে একটা সমতা হবে। এক জায়গায় খারাপ করলে অন্য জায়গায় ভালো হবে। যারা ফান্ডটা ব্যবস্থাপনা করবেন তাদের ওই ধরনের দক্ষতা থাকতে হবে। এখন কর্তৃপক্ষ সেই ধরনের যোগ্য লোক নিয়োগ দিতে পারবে কি না সেটা দেখার বিষয়। এছাড়া একটা স্বাধীন বোর্ড থাকতে হবে। এই ধরনের বিষয়গুলো যদি আমরা ঠিকমতো গঠন করতে না পারি তবে প্রথম দিকে হয়তো কিছু সারা মিলবে। ভরসা না পেলে পরে সমস্যা তৈরি হবে।’
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সর্বজনীন পেনশন সুবিধা একটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এটা কীভাবে বাস্তবায়ন হয়, এর যে ফান্ডটা হবে সেটা ফাইন্যান্সিং হয় কি না, অনেক জায়গায় পেনশন ফান্ড যেগুলো করা হয়, সেগুলো কন্ট্রিবিউট করা হয়। কন্ট্রিবিউশন থেকে যে ইনকাম হয় এই ইনকাম ভবিষ্যতে পেমেন্ট করা হয়। সেই ধরনের ব্যবস্থা না থাকলে যদি আবার সেই সরকারের টাকা ঘাটতি লাগে তাহলে তো সামাজিক নিরাপত্তার যেসব প্রকল্প আছে তেমন প্রকল্পই হয়ে গেল। এইভাবেই আমি বিষয়টা বিবেচনা করছি।’
সবার আগে নিরাপত্তার বিষয়টি স্পষ্ট করা আহ্বান জানিয়েছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘উদ্যোগটি ভালো হলেও সামনে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। কারণ, এখনো অর্গানোগ্রাম ঠিক করা হয়নি। অফিস হয়নি। কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়নি। যাকে পেনশন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান করা হয়েছে, তার এটা মূল কাজের অতিরিক্ত দায়িত্ব। কিন্তু এটা একটা বিশাল কর্মযজ্ঞ। আরও বড় প্রস্তুতির প্রয়োজন হবে। সামনে নির্বাচন তাই হয়তো রাজনৈতিক কারণে এর উদ্বোধন করা হয়েছে। আমার মনে হয়েছে, প্রশাসনিক দিক দিয়ে এটার প্রস্তুতি পর্যাপ্ত নয়।’
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমরা জানি না এর বিনিয়োগ পরিকল্পনা কী? কারণ, মানুষ যে টাকা দেবে, তার তো বিনিয়োগ পরিকল্পনা থাকতে হবে। তবে সামনে কমপক্ষে ১০ বছর সময় আছে। ১০ বছরের আগে তো আর কেউ পেনশন পাচ্ছেন না। সরকার হয়তো এর আগেই সব কিছু ঠিকঠাক করে নেবে। সরকারের নিরাপত্তার বিষয়গুলো আরও স্পষ্ট করতে হবে। বাংলাদেশে এখন সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশনের টাকা নিয়ে হয়ারানির অনেক নজির আছে। সেরকম যাতে না হয় সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। আর সবচেয়ে স্বচ্ছতার দাবি রাখে সমতা স্কিম। কারণ, এখানে সরকার সরসারি কন্ট্রিবিউট করবে। তাই প্রকৃত গরিব মানুষ যাতে সুবিধা পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।’
এদিকে গত বৃহস্পতিবার পেনশন স্কিম চালুর প্রথম দিনই ভালো সাড়া মিলেছে। সেদিন আট হাজারের বেশি গ্রাহক নিবন্ধনের আবেদন করেছেন। এর মধ্যে এক হাজার ৭০০ জন আবেদনের পুরো প্রক্রিয়া শেষ করে চাঁদা পরিশোধ করেছেন।
পেনশনের নিবন্ধন থেকে শুরু করে চাঁদা পরিশোধের পুরো প্রক্রিয়াটি অনলাইনে ২৪ ঘণ্টাই করা যাওয়ায় আবেদনকারীর সংখ্যা প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা।
টিএই/এমআর