বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

জ্বালানি নিরাপত্তায় বঙ্গবন্ধুর দর্শনের সুফল পাচ্ছে মানুষ

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ০৯ আগস্ট ২০২৩, ০৮:১৬ এএম

শেয়ার করুন:

জ্বালানি নিরাপত্তায় বঙ্গবন্ধুর দর্শনের সুফল পাচ্ছে মানুষ

জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস আজ (৯ আগস্ট)। এবারের প্রতিপাদ্য ‘স্মার্ট বাংলাদেশের প্রত্যয় জ্বালানির সাশ্রয়’। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশ। বিধ্বস্ত অঞ্চলে পরিণত হওয়া সারাদেশের প্রশাসন, অর্থনৈতিক অবকাঠামো, কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছিল বিপত্তি। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৭২ সালে দেশের শাসনভার গ্রহণ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শিল্প খাত উন্নয়নে নেন নানা পদক্ষেপ।

১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে এক যুগান্তকারী পরিকল্পনা নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ৯ আগস্ট ডাচ-রয়্যাল বহুজাতিক তেল গ্যাস কোম্পানি শেল অয়েল-এর কাছ থেকে ৪৫ লাখ পাউন্ড স্টার্লিংয়ে (তখনকার ১৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা) পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র কিনে নেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিতাস, বাখরাবাদ, রশিদপুর, হবিগঞ্জ ও কৈলাসটিলা-এই পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র কিনে নিয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন গ্যাস কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জ্বালানি খাতে এই সিদ্ধান্তকে দূরদর্শী পরিকল্পনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পরবর্তীকালে এই গ্যাসক্ষেত্রগুলো জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তার বড় নির্ভরস্থল হয়ে ওঠে। এর মাধ্যমেই বাংলার মাটিতে জ্বালানি নিরাপত্তার বীজ বপন করেন বঙ্গবন্ধু।


বিজ্ঞাপন


দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ১৫০০ কিলোমিটার বিদ্যুৎ লাইন স্থাপন করেন। বিদ্যুতের উৎপাদন ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে যেখানে ছিল ২০০ মেগাওয়াট, সেখানে ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০০ মেগাওয়াট। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭৩ সালে দেশব্যাপী পল্লী বিদ্যুৎ কর্মসূচি সমপ্রসারণের লক্ষ্যে একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হয়।

সোনার বাংলা বিনির্মাণে স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭২ সালে রচিত সংবিধানের ১৬ নং অনুচ্ছেদে নগর ও গ্রামাঞ্চলের জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করার উদ্দেশ্যে কৃষিবিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিককরণের ব্যবস্থা, অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর সাধনের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের অঙ্গীকার করা হয়।

১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড প্রকৌশলী সম্মেলনে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিকনির্দেশনামূলক ভাষণে বলেন যে, ‘বিদ্যুৎ ছাড়া কোনো কাজ হয় না, কিন্তু দেশের শতকরা ১৫ ভাগ লোক যে শহরের অধিবাসী সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহের অবস্থা থাকিলেও শতকরা ৮৫ জনের বাসস্থান গ্রামে বিদ্যুৎ নাই। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করিতে হইবে। ইহার ফলে গ্রামবাংলার সর্বক্ষেত্রে উন্নতি হইবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ চালু করিতে পারিলে কয়েক বছরের মধ্যে আর বিদেশ হইতে খাদ্য আমদানি করিতে হইবে না’।

স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার ৫৯ (চঙ-৫৯)-এর মাধ্যমে ১৯৭২ সালের ৩১ মে ওয়াপদাকে দুই ভাগে বিভক্ত করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড গঠন করার মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাতের এক নবদিগন্তের সূচনা করেন।  ফলশ্রুতিতে সমগ্র দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের দায়িত্ব অর্পিত হয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ওপর। ১৯৭২-৭৫ সময়ে আশুগঞ্জ, ঘোড়াশাল ও সিদ্ধিরগঞ্জ তিনটি পাওয়ার হাব প্রতিষ্ঠা করা হয়।  কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের অপরিসীম গুরুত্বের বিষয় বিবেচনা করে ১৯৭৭ সালের অক্টোবরে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) সৃষ্টি করা হয়।


বিজ্ঞাপন


বঙ্গবন্ধু সংবিধানের ১৪৩ নম্বর অনুচ্ছেদে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে দেশি জ্বালানি ও খনিজসম্পদের ওপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই পেট্রোলিয়াম ও সমুদ্র আইনসহ বেশকিছু আইন তৈরি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭২-এ পেট্রোবাংলা প্রতিষ্ঠা করে দেশের খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলন, পরিশোধন ও বাজারজাতকরণের সূচনা করেন। ১৯৭৫ সালে মাত্র সাড়ে ৪ লাখ পাউন্ডে শেল অয়েলের কাছ থেকে ৫টি গ্যাসক্ষেত্র কিনে রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থা থেকে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়তে মাত্র সাড়ে ৩ বছরেই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কুটিরশিল্প, কৃষি এবং জ্বালানিসহ সব খাতের জন্যই দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে শক্তিশালী করতে নানা পদক্ষেপ হাতে নিয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম ছিল জ্বালানি খাতে দেশকে স্বনির্ভর করা। সে ধারাবাহিকতায় পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র কিনে জ্বালানি নিরাপত্তার ভিত্তি রচনা করেছিলেন। তিনি পেট্রোবাংলা প্রতিষ্ঠা, পেট্রোলিয়াম অ্যাক্ট, যুক্তরাষ্ট্রের এসো ইস্টার্ন সরকারিভাবে গ্রহণ তেল ও গ্যাস খাতের বিকাশ সুগম করেছেন। জাতির পিতা যেসব ইঞ্জিনিয়ারকে রাশিয়া পাঠিয়েছিলেন, তারাই এখন দেশের বিভিন্ন খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। জ্বালানি নিরাপত্তায় দেশবাসী এখন পর্যন্ত যা সুফল পাচ্ছে তা বঙ্গবন্ধুর দর্শনের ফল।

গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর হঠাৎ করেই চরম জ্বালানি সংকটে পড়ে পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশ। জ্বালানি খাতে আমরা প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর হওয়ায় বাংলাদেশকেও পড়তে হয়েছে সেই সংকটে। বঙ্গবন্ধুর জ্বালানি নীতির পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে হলে এমন চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তোরণ সম্ভব।

সংকটের পড়ার পর থেকে গ্যাস অনুসন্ধানে অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। ফলস্বরূপ ২০২২ সালে রেকর্ড সংখ্যক কূপ খনন করেছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান তৈল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। আরও গ্যাস অনুসন্ধান ও কূপ খননের দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি বেশকিছু পরিকল্পনাও গ্রহণ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে পেট্রোবাংলা চলতি বছরে মোট ৯টি কূপ খননের কার্যক্রম গ্রহণ করে। এর মধ্যে ৩টি অনুসন্ধান কূপ টবগী-১, শ্রীকাইল নর্থ-১ ও শরীয়তপুর-১; ১টি উন্নয়ন কূপ ভোলা নর্থ-২ এবং ৫টি ওয়ার্কওভার কূপ সিলেট-৮, কৈলাশটিলা-৭, সালদা-২, সেমুতাং-৬ ও বিয়ানিবাজার-১।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য আগামী ২ বছর ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, এই ২ বছর আমাদের 'ব্যাঙলাফ' দিয়ে এগুতে হবে। আমরা এমনিতেই পিছিয়ে আছি। করোনাভাইরাস আসবে, সেটা তো কেউ জানতো না। সেজন্য আমাদের ২ বছর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোনো ইঞ্জিনিয়ার, কনসাল্টেন্ট, বিদেশি কর্মী কেউ তখন ছিল না। পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলো। গ্যাসের দাম উঠল ১৬৭ ডলারে, যেটা এখন আমরা মাত্র ১১ ডলারে পাচ্ছি।'

প্রতিমন্ত্রী বলেন, 'এই ২ বছরের মধ্যে আমাদের লোকাল গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে হবে, কমপক্ষে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট আমাদের টার্গেট আমরা ভোলার গ্যাস খুলনায় নিয়ে আসার জন্য পাইপলাইনের কাজে হাত দেব। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের যত পুরোনো গ্যাসের পাইপলাইন আছে, সবগুলো নতুন করে বসাতে হবে, কমপক্ষে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা লাগবে। এগুলোকে অটোমেটেড করতে হবে।

সবগুলো কাজ একসঙ্গে করা খুবই চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মন্তব্য করেন প্রতিমন্ত্রী। বলেন, 'বর্তমান সরকার জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অনেক কিছুই করেছে, আরও অনেক কাজ করছে।'

দেশে প্রচুর জ্বালানি সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অনারারি অধ্যাপক বদরূল ইমাম। তিনি বলেন, 'দেশীয় সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই ছিল বঙ্গবন্ধুর দর্শন। আমাদের এলএনজি আমদানিতে নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় জ্বালানি অনুসন্ধানে জোর দিতে হবে। আমাদের দেশের দুই-তৃতীয়াংশ অঞ্চল এখনো অনুসন্ধান কার্যক্রমের বাইরে আছে। বিশাল সমুদ্রের কোনো সম্পদই আমরা এখনো আহরণ করতে পারিনি। আমাদের এখন পর্যন্ত যত গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে, সবগুলোই খুব সহজে পাওয়া যায় এমন গ্যাসক্ষেত্র। যেসব গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে আমাদের অনেক বেশি শ্রম দিতে হবে, সেগুলোতে এখনো আমরা হাত দেইনি। গ্যাস ছাড়াও আমাদের কয়লা, খনিজ বালু, লোহার খনিসহ অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, সেগুলোতেও মনোনিবেশ করতে হবে।

টিএই/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর