আগের চেয়ে দাম কমেছে পেঁয়াজের তবে এখনো দেশি পেঁয়াজ বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা বা আরও বেশি দরে। আর আমদানি করা ভারতীয় পেঁয়াজ ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজি। হঠাৎ দাম বেড়ে ৯০-১০০ টাকা ধরে বিক্রি হওয়া পেঁয়াজ সে হিসেবে অনেকটাই কমেছে। তবে এরই মধ্যে বেড়েছে রসুনের দাম। গত এক মাসে কেজিতে ৪০ থেকে ৫০ টাকার মতো কেজিতে বেড়ে আমদানি করা রসুন ২২০ থেকে ২৪০ এবং দেশি রসুন ১৮০ থেকে ২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
গত ২৪ ও ২৫ জুলাই রাজধানীর পাইকারি ও খুচরাসহ কয়েকটি বাজার ঘুরে এমন বাজার দর দেখা গেছে।
বিজ্ঞাপন
গত মার্চ মাসের শেষে পেঁয়াজের বাজার অস্থির হতে শুরু করে। গত জুনের শুরুতে দাম প্রতি কেজিতে ৯০ থেকে ১০০ টাকা ধরে বিক্রি হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ৫ জুন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। এই অনুমতির পর থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ৯৮৭টি পেঁয়াজ আমদানির আইপি অনুমোদন দিয়েছেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং।
৯৮৭টি আইপির বিপরীতে ১১ লাখ ৩৭ হাজার ১০৩ মেট্টিক টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ২৪ জুলাই পর্যন্ত দেশে এসেছে ২ লাখ ৪৬ হাজার ২৬৫.২৬ মেট্টিক টন পেঁয়াজ। সর্বশেষ ২৪ জুলাই দেশে এসেছে ৪ হাজার ৩৭৪ মেট্টিক টন পেঁয়াজ। আমদানির পর দাম কমতে থাকে পেঁয়াজের, তবে দেশি পেঁয়াজ এখনো কেজিতে ৬০ টাকার উপরে। কোথাও ৬৫ বা ৭০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে। তবে আমদানি পেঁয়াজ ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
কারওয়ান বাজারের পার্ক মার্কেটে পাইকারি ও খুচরা দুই ভাবেই পেঁয়াজ বিক্রি করেন ব্যবসায়ী মো. নুরুল ইসলাম। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, পেঁয়াজের দাম আগের চেয়ে কম তবে অনেকেই প্রশ্ন করে দেশির দাম কমে না কেন। আরে ভাই যদি ভারতের পেঁয়াজ না আসতো তাহলে এই সময়ে পেঁয়াজের দাম ১৫০-২০০ টাকা কেজি পর্যন্ত হইয়া যাইতো অটোমেটিক।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, আমাদর কাছে একটা পেঁয়াজ আছে দেশি এবং হাইব্রিড মিক্সড ২৮০ টাকা পাল্লা, (এক পাল্লা ৫ কেজি) আর একদম দেশিটা ৩২০ টাকা পাল্লা আর ইন্ডিয়ান ২১০ টাকা পাল্লা বিক্রি করছি।
পাশের আরেক বিক্রেতা আজিজুল বলেন, এখানে দেশি পেঁয়াজ ৫ কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩৩০ টাকা পর্যন্ত। মনে করেন যেটা বাছাই করা পেঁয়াজ সেটার দাম একটু বেশি আবার দেশির সাথে হাইব্রিড মেশানো থাকলে একটু দাম কম হয়। ২৮০ টাকা ধরে বিক্রি হলে এক কেজির দাম পড়ে ৫৬ টাকা আর সেই পেঁয়াজ পাশের খুচরা দোকানে এক কেজি বা দুই কেজি কিনতে গেলে ৬০ বা ৬৫ টাকা ধরে কিনতে হয়।
খুচরা বিক্রেতা খালেক মিয়া বলেন, একবস্তা পেঁয়াজে নষ্ট হয় অনেক সময় পচন ধরে। পাঁচ-দশ কেজি কিনলে আমরাও কমে বেচি কিন্তু এক দুই কেজি কিনলে ৬০ এর নিচে বেচা যায় না।
উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং অতিরিক্ত উপপরিচালক (আমদানি) অঞ্জন চন্দ্র মন্ডল ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা আমদানির অনুমতি দেওয়ার পর বাজারে দামও কমেছে পেঁয়াজের। এখনো অনুমতি দিচ্ছি। পেঁয়াজের পাশাপাশি মরিচ, টমেটোর জন্যও অনেকে আবেদন করছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ৩৫ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে। আর এ বছর উৎপাদন হয়েছে ৩৪ লাখ টন। পেঁয়াজের সংগ্রহ থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে বিভিন্ন ধাপে অপচয় ২৫-৩০ শতাংশ বাদে গত বছর নিট উৎপাদন হয়েছে ২৪ দশমিক ৫৩ লাখ টন।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ২৮-৩০ লাখ টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি হয় ৬ লাখ টন।
রাজধানীর পাইকারি পেঁয়াজ বিক্রেতা আশরাফ হোসেন। তিনি পাবনা থেকে পেঁয়াজ এনে বিক্রি করেন। আশরাফ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, সবাই কয় পাইকারি বিক্রেতারা সুখে আছে। বিশ্বাস করেন এককেজি পেঁয়াজে আমরা লাভ করি আটআনা বা সর্বোচ্চ ১ টাকা। আমাদের টিকে থাকাই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যখন দাম বেড়েছিল তখন একটু লাভ করেছিলাম। তখন দুই টাকা, তিনটাকাও লাভ হয়েছে প্রতিকেজিতে। ওইসময় যারা গৃহস্থ কৃষক তারা আরও দাম বাড়বে সে আশায় বিক্রি করতে চাচ্ছিল না পরে ভারতের পেঁয়াজ আসা শুরু হয় দামও কমতে থাকে। আমার পাবনায় মোকাম আাছে এখানে মোকাম ভাড়া দিতে হয় এরকম সবারই।
এই পাইকারি বিক্রেতা আরও বলেন, এক বস্তায় ৮০ কেজি পেঁয়াজ ঢাকায় আনতে গাড়ি ১৩০ টাকা, এখানে কারওয়ান বাজারে খরচ ৯০ টাকা, পাবনায় মোকামখরচ এবং লেবার খরচ আছে এরপরে লাভের হিসেব।
পেঁয়াজের বর্তমান দামের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেশির মধ্যে পাবনার পেঁয়াজের দাম এখন সবচেয়ে বেশি ৩২০-২৪০ টাকা ৫ কেজি বা এক পাল্লা। বাজারে আরও একটু কমেও পাওয়া যায় সেগুলো ফরিদপুর অন্যান্য এলাকার ভ্যারাইটিজ পেঁয়াজ। ১৮০ থেকে ২২০ পর্যন্ত ইন্ডিয়ান পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে বলেন তিনি।
রাজধানীর শুক্রবাদ, হাতিরপুল বাজারে দেশি পেঁয়াজ ৬০ থেকে ৭০ টাকা প্রতি কেজি বিক্রি করতে দেখা গেছে।
রসুনের দাম বাড়ছে
কয়েক দিনে বেশ বেড়েছে রসুনের দামও। কেজিতে দাম বেড়েছে ৪০ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত। বাজার ঘুরে দেখা যায়, খুচরা পর্যায়ে প্রতিকেজি দেশি রসুন বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২৩০ টাকায়। আর আমদানিকৃত রসুন বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত।
বিক্রেতারা জানান, বাজারে দেশি রসুনের সরবরাহ কম ও বিদেশ থেকে রসুনের আমদানি কম হওয়ায় দাম বাড়ছে রসুনের। খুচরা বাজারে বাড়তি দামে বিক্রি হলেও পাইকারি পর্যায়ে দেশি রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৭০-১৮০ টাকা থেকে আর চায়না রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা।
কারওয়ান বাজার পাইকারি বাজারে আড়তদার হাফিজুর জানান, পাইকারিতেও আগের চেয়ে দাম কিছুটা বেড়েছে। আমাদের থেকে কিনে নিয়ে খুচরা পর্যায়ে একটু বাড়তি দামে বিক্রি হয়। বুঝেনইতো হাত বদল হলেই বেড়ে যায় পণ্যের দাম। কারণ, খুচরা পর্যায়ে পরিবহন ও শ্রমিক খরচ লাভের অংশ যুক্ত করেই বিক্রি করে।
একই বাজারে পাইকারি দোকান কহিনুর এন্টারপ্রাইজে কথা বললে দোকানদার জানান, চায়না রসুন ৩০ কেজির বস্তা রসুন নিলে ১৭০/১৭৫ করে রাখা যাচ্ছে। ৫/১০ কেজি কিনলে ১৯০/২০০ টাকা করে পড়বে। ওই দোকানদার আরও বলেন, এটাই অন্যান্য বাজারে ২২০ বা আরও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। আর এক বস্তা নিলে একটু কম রাখা যায়।
শ্যামবাজারের অজয় টেডার্সের মো. রতন বলেন, পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ে গেলে প্রতিটি পণ্যের দামই বাড়ে। শ্রমিক ও পরিবহন খরচসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচের জন্য দাম বাড়ে। এ ছাড়া বাজারে রসুনের কিছুটা সরবরাহ ঘাটতিও রয়েছে।
কারওয়ান বাজারে পাইকারিতে দেশি রসুন বেশির ভাগ দোকানে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকার মধ্যে কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা যায়। আর চায়না বড় রসুন বিক্রি হচ্ছিল ১৮৫ থেকে ১৯০ টাকা। অথচ খুচরা বাজারে আরও কয়েকগুণ বেশি। পশ্চিম রাজাবাজার কাঁচা বাজারে দেশি রসুন ২২০ টাকা কেজি বিক্রি করতে দেখা যায়। আর চায়না রসুনের দাম চাচ্ছিলেন ২৪০ টাকা কেজি।
হাতিরপুল বাজারে এক বিক্রেতার কাছে জানতে চাইলে বলেন, চায়না রসুন ২৫০ টাকা তবে ২৪০ রাখা যাবে। এটার চাহিদা বেশি, দেশি রসুনের চেয়ে এখন আমদানি করাটার দাম বেশি।
পহেলা জানুয়ারি থেকে এখন ২৪ জুলাই পর্যন্ত ২ লাখ ৫৬ হাজার ৯০৯.৭৫ মেট্টিক টন রসুন আমদানির অনুমোদন দিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং। আর দেশে এসেছে ৬৬ হাজার ১১৮ মেট্টিক টন।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, বাজারে সব ধরনের জিনিসের দামে বেশ নাজেহাল মানুষ। একটির কমে আরেকটির বাড়ে। বাজারে আগের চেয়ে আমদানি পেঁয়াজের দাম কম কিন্তু দেশি পেঁয়াজ দাম এখনে ৬০ বা ৭০ টাকা কেজি। আমদানি পেঁয়াজের দাম কমায় একটু স্বস্তি পেয়েছে আবার রসুনের দাম বেড়েছে। আসলে বাজারে একটা ‘শক্ত মনিটরিং’ দরকার। আমরা সেটি ইদানিং দৃশ্যমান দেখছি না।
তিনি আরও বলেন, মাঝখানে চিনির দাম বাড়লে যখনই বাণিজ্য সচিব বললেন আমরা জোরালো মনিটরিং বাড়াব এরপর কিন্তু বেশ কমতে থাকে। সুতরাং বাজারে মনিটরিং জোরালো করার কোনো বিকল্প নেই। আরেকটা বিষয় দেশি পেঁয়াজ দাম কমছে না কেন এতে আড়তদারদদের কোনো ষড়যন্ত্র আছে কিনা দেখা দরকার।
কী ধরনের ষড়যন্ত্র জানতে চাইলে ক্যাব সহ-সভাপতি বলেন, যারা মজুদ রেখেছেন তারাতো বিক্রি করতে চাইবে কিন্তু আড়তদাররা যদি বলে এটি বিক্রি কম হয় নেবে না তাহলে দিনশেষে মজুদদার ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ডব্লিউএইচ/এএস