শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

কাঁচা মরিচের দাম বাড়ার কারণ কী?

ঢাকা মেইল ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩ জুলাই ২০২৩, ১০:৩৭ এএম

শেয়ার করুন:

কাঁচা মরিচের দাম বাড়ার কারণ কী?

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঊর্ধ্বগতির তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে কাঁচা মরিচ। দুই সপ্তাহ ধরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় তিন গুণ দাম ছাড়িয়েছে রান্নার এই অনুষঙ্গটির। যা বছর ব্যবধানে বেড়েছে ৬ গুণ। তবে কৃষক ও ব্যবসায়ীদের দাবি— টানা দুই মাস খরা, এরপর অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত— এই দুই কারণে উৎপাদন ব্যহত হয়েছে কাঁচা মরিচের। এতে চাহিদার তুলনায় বাজারে কম ছিল পণ্যটি। এজন্যই দাম বেড়ে গিয়েছে। 

রোববার (২ জুলাই) রাজধানীর বিভিন্ন কাঁচা বাজার ঘুরে দেখা যায়, খুচরা পর্যায়ে কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকায়। দুই সপ্তাাহ আগেও যার দাম ছিল ৮০ থেকে ১০০ টাকা। খুচরা দোকানিরা বলছেন— পাইকাররাই তাদের কাছে কাঁচা মরিচ বিক্রি করছেন ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা। ফলে তাদেরও বিক্রি করতে হচ্ছে চড়া দামে। এতে আগে যেসব ক্রেতা আধা বা এক কেজি মরিচ কিনতেন তারা এখন কিনছেন ৫০ থেকে ১০০ গ্রামের মতো। 


বিজ্ঞাপন


তাসলিমা আক্তার একজন গৃহিণী। নূরের চালার কাঁচা বাজার থেকে ৩০ টাকায় ৫০ গ্রাম মরিচ কিনছিলেন তিনি। গুনে দেখা যায় ৫০ গ্রামে ৩৫টির মতো মরিচ পেয়েছেন এই গৃহিণী। এর মধ্যে ব্যবহারের অযোগ্য ছিল ৫ থেকে ৬টি মরিচ। সেই হিসাবে প্রতিটি মরিচের মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১ টাকার মতো। 

তাসলিমা আক্তার বলেন, ৩০ টাকায় কেনা মরিচগুলো তো দেখার মতোও না। দুই সপ্তাহ আগে ১০ টাকায় এর চেয়ে বেশি মরিচ পেতাম। এই কয়টা কিনছি ভাতের সাথে কাঁচা খাওয়ার জন্য। তরকারিতে তো মরিচ দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। শুকনা ও গুঁড়া মরিচ দিয়েই চালাতে হচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম দেখলে মনে হয় গলায় পাড়া দিয়ে দাম রাখছে।

কাঁচা মরিচ

জীবদ্দশায় কাঁচা মরিচের এত দাম কেউ দেখেনি 
ব্যবসায়ীদের দাবি—  অতিবৃষ্টিতে উৎপাদন কম এবং ঈদের ছুটিতে পরিবহন সংকটের কারণে দাম বেড়েছে। 


বিজ্ঞাপন


কালি কান্ত একজন ব্যবসায়ী। নূরের চালা কাঁচা বাজারে দোকান তার। তিনি বলেন, ঈদের কারণেই মরিচের দাম বাড়তি। বৃষ্টি-বাদলের কারণে রাস্তাঘাট তলিয়ে গিয়েছে, এজন্য গাড়ি আসতে পারেনি। গাড়ি না পাওয়ার আরও বড় একটি কারণ ঈদুল আজহা। এছাড়া পাইকাররা হাটে মরিচ পায় না, এজন্য তারাও আনতে পারে না। আমরাও পারি না।

প্রায় ২৫ বছরের সবজি বিক্রির ব্যবসায় কাঁচা মরিচের দাম কখনও এতটা বাড়তে দেখেননি তিনি।

কাঁচা মরিচ উৎপাদনে সমৃদ্ধ ঝিনাইদহের শৈলকূপা। রোববার এই এলাকায়ও কাঁচা মরিচের দাম ছিল ৬০০ টাকা। কিন্তু শনিবার সেখানকার কাঁচা বাজারে খুচরা পর্যায়ে মরিচ বিক্রি হয়েছে ১০০০ টাকা দরে। 

জীবদ্দশায় কখনও কাঁচা মরিচের দাম এতটা বাড়তে দেখেননি ক্রেতা সোহান আহমেদ, কাঁচা মরিচের কেজি গরুর মাংসের কেজির চাইতে বেশি। এটা তো কখনও ভাবিওনি। এই টাকায় তো কখনই মরিচ কেনা সম্ভব না। পরে আমি বোম্বাই মরিচ কিনেছি, শুকনা মরিচ দিয়ে কাজ চালাচ্ছি।

বিক্রি তলানিতে
হঠাৎ করেই আগুন দামের কারণে তলানিতে নেমেছে কাঁচা মরিচ বিক্রি। দাম বাড়ার আগে যেসব ব্যবসায়ী মরিচ কিনে রেখেছেন তারা পড়েছেন বিপাকে। তাদেরই একজন শৈলকূপার খুচরা ব্যবসায়ী নবীন মিয়া। সময় মতো বিক্রি না করতে পারায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তার কাছে থাকা কাঁচা মরিচ। 

শৈলকূপার এই ব্যবসায়ী বলেন, শনিবার সকালে মরিচের পাইকারি দাম ছিল ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা। তাই খুচরায় ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা কেজি বিক্রি করতে হয়েছে। বৃষ্টিতে অনেক মরিচ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। পানির জন্য গাড়ি আসতে পারছে না। দুপুরের মধ্যে আমার টুকরি খালি হয়ে যাওয়ার কথা। এখন কেউ কিনেই না। আজকে লসে ছাড়তে হচ্ছে, উপায় নেই।

ঢাকার খুচরা বাজারেও সেটার প্রতিফলন দেখা গিয়েছে। বেশিরভাগ দোকানে কাঁচা মরিচ খুঁজেও পাওয়া যায়নি। যে কয়জন বিক্রি করছেন। তাদের দেখা গিয়েছে ছোট টুকরিতে অল্প কিছু মরিচ নিয়ে বসেছেন।

ভ্যানে ফেরি করে সবজি বিক্রি করেন মাহাদি হাসান। তিনি জানান, দাম অনেক বেশি, তাই আজকে আর মরিচ আনিনি। গতকালের মরিচগুলোই বিক্রি হচ্ছে না। সবাই ৫০-১০০ গ্রাম করে নিচ্ছে। কাঁচা মরিচের দাম বাড়ায় আমাদের তো কোনো লাভ নেই। আমরা যে দামে কিনবো, ওই হিসাবেই বিক্রি করবো।

কাঁচা মরিচ

খরা/বৃষ্টি
কৃষকরা বলছেন, মে ও জুন মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত খরা থাকায় মরিচের ফলন ভালো হয়নি। বাজারে এমন দুর্দশার এটিও বড় কারণ। 

চলতি বছর ফরিদপুরের শোলাকুন্ড গ্রামে অন্তত ১০০ একর জমিতে মরিচ চাষ হয়েছে। কিন্তু বলতে গেলে উৎপাদন শূন্য।

স্থানীয় কৃষক কলম চকদার বলেন, খরায় সব গাছে কুঁকড়া লেগে গিয়েছিল, মানে গাছ বাড়ছিল না। মাটিতে রস নেই, গাছ ছোট হয়ে কোনো ফল ধরেনি। আগে এই সময়ে ১ একর জমি থেকে প্রতি সপ্তাহে ২০ থেকে ৩০ মণ মরিচ তুলতাম। এবারে দুই তোলা মরিচও ওঠেনি। পুরাই জিরো (শূন্য)। লস তো হয়েছে অনেক, কিন্তু প্রকৃতির খেলায় কাকে দোষ দেবো?

এছাড়া মরিচের বাড়তি দামের মধ্যে খোদ চাষিরাই কিনে খাচ্ছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি। তবে তিনি মনে করেন— বৃষ্টি শুরু হওয়ায় মরিচ গাছগুলোয় প্রাণ ফিরতে শুরু করেছে। খুব শিগগিরই উৎপাদন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে এবং কাঁচা মরিচের দাম আগের মতো নাগালের মধ্যে চলে আসবে। 

স্বদেশ কুমার পাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্রধান কৃষিতত্ত্ববিদ। তিনি জানিয়েছেন, সাধারণত বর্ষার মৌসুম, বিশেষ করে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যখন বেশি থাকে তখন মরিচ গাছের ফুল পড়ে যায়, গাছও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বৃষ্টিপাতের কারণে কৃষকরা সেভাবে গাছের পরিচর্যা করতে পারেন না, এতে মরিচ সংগ্রহ কমে যায়। সব মিলিয়ে সার্বিক উৎপাদন ব্যহত হওয়ার কারণেই বর্ষা মৌসুমে বাজারে কাঁচা মরিচের দাম বেড়ে যায়। 

তিনি বলেন, এপ্রিল থেকে তীব্র খরা, এখন মুষলধারে বৃষ্টি। প্রকৃতির এমন বিরূপ আচরণে মরিচ গাছ বাড়তে পারেনি। এখন যে কটায় ফুল এসেছে, সেগুলো বৃষ্টিতে ঝরে যাচ্ছে। এজন্যই ফলন কম। প্রতি বছরই এমন হয়। তবে এবারের মতো দাম কখনও বাড়েনি। বৃষ্টিপাত একটু কমে এলেই দাম পড়ে যাবে। তাছাড়া আমদানি তো হচ্ছেই।

তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইংয়ের অতিরিক্ত পরিচালক মো. আশরাফ উদ্দিন দাবি করেন, কাঁচা মরিচের দাম এতটা বেড়ে যাওয়ার খবর সম্পূর্ণ গুজব। তিনি বলেন, আমি তো দেখলাম কাঁচা মরিচ এখন ৪০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। ৬০০ টাকা, ১০০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হওয়ার ঘটনা গুজব বলেই মনে হচ্ছে। বৃষ্টির কারণে মরিচের দাম বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু এত বাড়েনি।

কৃষি তথ্য সার্ভিস বলছে, সর্বনিম্ন ১০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এবং সর্বোচ্চ ৩৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় মরিচ গাছের বৃদ্ধিতে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা যায়। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হলে মরিচ গাছের পাতা ঝরে যায় এবং গাছ পচে যায়। সেক্ষেত্রে রবি মৌসুম কাঁচা মরিচ ফলনের সবচেয়ে উপযোগী সময়। বাকি সময়ে বিশেষ করে বর্ষায় উৎপাদন সবচেয়ে কমে যায়।

কাঁচা মরিচ আমদানি

আমদানি শুরু
এদিকে ঈদের ছুটি শেষে ভারত থেকে কাঁচা মরিচ আমদানি শুরু হয়েছে। রোববার সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে ছয় ট্রাকে মোট ৫৫ টন ভারতীয় কাঁচা মরিচ দেশে প্রবেশ করেছে। বন্দর তথ্য কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আরও প্রায় ৫০ ট্রাক কাঁচা মরিচ প্রবেশের অপেক্ষায় আছে।

কাঁচা মরিচ বন্দরে প্রবেশ করলেও বড় বাজারে এখনো এসে পৌঁছেনি। আমদানি অব্যাহত থাকলে দেশের বাজারে কাঁচা মরিচের দাম প্রতি কেজি ৫০ থেকে ৬০ টাকায় নেমে আসবে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

ঈদের কিছু দিন আগ থেকে কাঁচা মরিচের দাম ৪০০ টাকায় উঠে যাওয়ায় গত ২৬ জুন ভারত থেকে কাঁচা মরিচ আমদানির অনুমতি দেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। ওই দিন থেকেই আমদানির অনুমোদন অর্থাৎ ইম্পোর্ট পারমিট দেওয়া শুরু হয়। একই দিন দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে পাঁচ ট্রাকে ২৭ হাজার ১৬৬ কেজি বা প্রায় ৩০ টনের মতো কাঁচা মরিচ ভারত থেকে দেশে ঢুকে। কিন্তু পরদিন ২৭ জুন থেকে ১ জুলাই পর্যন্ত টানা পাঁচ দিন ঈদের ছুটিতে বন্দরে আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। এতেই অস্থির হয়ে উঠে কাঁচা মরিচের বাজার। এখন সব খুলে যাওয়ায় মরিচের সরবরাহ স্বাভাবিক হতে শুরু করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ নিয়ে রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত দেশে এসেছে মোট ৯৩ টন কাঁচা মরিচ।

কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত ৩৬ হাজার ৮৩০ টন কাঁচা মরিচ আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আমদানির এই অনুমতি আগামী ৩ মাসের জন্য বহাল থাকার কথা রয়েছে।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব অনুযায়ী, রোববার কাঁচা মরিচের পাইকারি দর ৫৬০ টাকা এবং খুচরা দর ৫৮০ টাকা ধরা হয়েছে। যা গত সপ্তাহেও ছিল প্রায় অর্ধেক। অর্থাৎ পাইকারিতে ২৪০ টাকা এবং খুচরা বাজারে ৩০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হতো। এক মাস আগে ছিল তারও অর্ধেক অর্থাৎ পাইকারিতে ১২০ টাকা এবং খুচরা বাজারে ১৬০ টাকা কেজি। গত বছর এই সময়ে মরিচের কেজি ছিল পাইকারি ৮০ এবং খুচরায় ১০০ টাকা।

এইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর