বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ঢাকা

সয়াবিন তেলের জন্য চট্টগ্রামে ক্রেতাদের হাহাকার

এম আই খলিল
প্রকাশিত: ০৩ জুন ২০২৩, ০৮:৪৭ পিএম

শেয়ার করুন:

সয়াবিন তেলের জন্য চট্টগ্রামে ক্রেতাদের হাহাকার
ছবি : ফাইল

চট্টগ্রাম মহানগরীর পাহাড়তলী এলাকার বাসিন্দা কামাল হোসেন। পাহাড়তলী বাজার থেকে তিনি নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় পণ্য কিনেন। তবে ভোজ্যতেল, চিনি, লবণ, চা-পাতার মতো নিত্যপণ্য এক সপ্তাহ বা ১৫ দিনের জন্য হিসেব করেও কিনেন। 

এরমধ্যে সয়াবিন তেল শেষ হয় তার। তাই শনিবার (৩ জুন) সকালে বাজারে সয়াবিন তেল কিনতে গিয়ে চার-পাঁচ দোকান ঘুরেও তিনি তা পাননি। শেষে বাড়ির পাশের ছোট্ট দোকানে গিয়ে এক লিটারের ২টি সয়াবিনের পলিপ্যাক পান। যা প্রতি লিটার ২শ টাকা দরে কেনেন তিনি। 


বিজ্ঞাপন


তিনি বলেন, শুধু শনিবার নয়, বৃহস্পতিবার-শুক্রবারও সয়াবিন তেল কেনার জন্য পাহাড়তলী বাজারের দোকানে-দোকানে ঘুরেছি। সব দোকানদারের এক কথা-সয়াবিন তেল নাই। কোম্পানি সরবরাহ দিচ্ছে না। এ রকম হলে দেশ কীভাবে চলবে বুঝতে পারছি না। 

শুধু কামাল হোসেন নয়, ওই বাজারে সয়াবিন তেলের জন্য দোকান থেকে দোকানে ছুটতে দেখা যায় অনেক ক্রেতাকে। তেল না পেয়ে সবাই হা-পিত্যেস করতে দেখা গেছে। আবার শুধু পাহাড়তলী বাজার নয়, নগরীর বহদ্দারহাট বাজারে গিয়েও দেখা গেছে একই চিত্র। ক্রেতাদের মুখে সয়াবিন তেল না পাওয়ার বন্দনা। 

বিষয় কি জানতে চাইলে বহদ্দারহাট যমুনা স্টোরের মালিক দিদার হোসেন বলেন, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ থেকে তেল আসছে না। সেখানেও সয়াবিন তেল নেই। কিন্তু ক্রেতাদের অভিযোগ- প্রতি লিটারের পলিপ্যাক ২০০ টাকায় ক্রয় করলে দোকানদাররা খাটের নিচ থেকে বা দোকানের পেছন থেকে তেল এনে বিক্রয় করছেন। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বহদ্দারহাটের হাটহাজারী স্টোরের মালিক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমাদের কাছে বোতলজাত কোন সয়াবিন তেল নেই। তবে পুষ্টি কোম্পানি কিছু পলিপ্যাক সরবরাহ করেছে, তাও দাম বেশি। যা আমাদের নিয়মিত কাস্টমারদের কাছে বিক্রয় করছি। 

এ বিষয়ে খবর নেওয়ার জন্য শনিবার দুপুরে নগরীর ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে গেলে দেখা যায়, সেখানেও সয়াবিন তেলের সংকট। হক অ্যান্ড সন্স নামে ভোজ্য তেলের আড়তদার আবদুল মালেক বলেন, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো সয়াবিন তেল সরবরাহ দিচ্ছে না, তাই বাজারে সংকট তৈরি হয়েছে। আমরা খুবই সীমিত পরিসরে তেল সরবরাহ করতে পারছি। 

ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, বিদেশ থেকে এখন প্রচুর পরিমাণে ভোজ্যতেল আমদানি করা হচ্ছে। রমজান থেকে এ পর্যন্ত অনেক ভোজ্যতেল খালাস করা হয়েছে। কিন্তু বাজারে তেলের সংকট। এত ভোজ্য তেল যাচ্ছে কই কিছুই বুঝতেছি না। আর এই সংকটের কারণে দেশের বাজারে সয়াবিন তেলের দামও খুব চড়া।  

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থ বছরের গত ১০ মাসে নৌপথে ৫ লাখ ৭৪ হাজার ২০৭ টন ক্রুড সয়াবিন এবং ১১ লাখ ৪৩ হাজার ৪৯২ টন পাম তেল আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে গত এপ্রিল মাসে সয়াবিন ও পাম অয়েল মিলে ২ লাখ ৪৭ হাজার ৯৪৮ মেট্রিক টন তেল আমদানি হয়েছে। আর গত অর্থবছরের একই সময়ে ৫ লাখ ৬৩ হাজার ১৩৮ টন ক্রুড সয়াবিন ও ৮ লাখ ৭ হাজার ৬৭১ টন পাম তেল আমদানি করা হয়। 

খাতুনগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. ইদ্রিস বলেন, বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমতির দিকে। প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম এখন ১ হাজার ১৯৩ ডলার। যা বাংলাদেশি টাকায় এক লাখ ২৬ হাজার ৭৫৬ টাকা। অর্থাৎ প্রতি লিটারের দাম ১২৬ টাকা ৭৫ পয়সা। আর গত মার্চের শেষ পর্যন্ত সয়াবিন তেলের দাম টনে কমেছে ৪৬২ মার্কিন ডলারের বেশি। অর্থাৎ প্রতি লিটারের বাংলাদেশি টাকায় কমেছে ৪৯ টাকারও বেশি। অথচ বাংলাদেশের বাজারের সয়াবিন তেল ২০০ টাকার নিচে মিলছে না। সরবরাহ না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান তিনি। 

তিনি বলেন, দেশে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল খোলা ১৭৩ টাকা এবং বোতলজাত ১৯৯ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। কিন্তু নানান অজুহাতে কোম্পানিগুলো সরবরাহ সংকট তৈরি করে অতিরিক্ত দাম নিয়ে মুনাফা করে যাচ্ছে। বোতলজাত সয়াবিনের দামে বিক্রয় করা হচ্ছে পলিপ্যাক বা খোলা সয়াবিন তেল। তবে ছোট ব্যবসায়ীদের এলসি খোলার অনুমতি দিলে সয়াবিন তেলের সংকট ও দাম কমে আসবে। 

তিনি জানান, চট্টগ্রামের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে সয়াবিন ও পাম তেলের বাজার এখনো বাড়তির দিকে। বিভিন্ন ব্রান্ডের পাম অয়েল মণপ্রতি ৪ হাজার ৯৫০ থেকে ৫ হাজার টাকায় বিক্রয় হচ্ছে। যা এক মাস আগেও ৪ হাজার ৬৫০ টাকা ছিল। আর তিন মাস আগে মণপ্রতি ৪৩০০ টাকা ছিল। একই অবস্থা সয়াবিন তেলের বাজারেও। খোলাবাজারের সয়াবিনের মণপ্রতি দাম ৬ হাজার ৫০০ থেকে ৬৬০০ টাকা। যা এক মাস আগে ৬২০০ টাকা পর্যন্ত ছিল।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থ বছরের গত ১০ মাসে নৌপথে ৫ লাখ ৭৪ হাজার ২০৭ টন ক্রুড সয়াবিন এবং ১১ লাখ ৪৩ হাজার ৪৯২ টন পাম তেল আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে গত এপ্রিল মাসে সয়াবিন ও পাম অয়েল মিলে ২ লাখ ৪৭ হাজার ৯৪৮ মেট্রিক টন তেল আমদানি হয়েছে। আর গত অর্থবছরের একই সময়ে ৫ লাখ ৬৩ হাজার ১৩৮ টন ক্রুড সয়াবিন ও ৮ লাখ ৭ হাজার ৬৭১ টন পাম তেল আমদানি করা হয়। 

বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একদিকে আমদানি বেশি, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম নিম্নমুখী। এরপরও দেশের বাজারে অস্থিরতা হওয়ায় পেছনে আমদানিকারক-মিলমালিকদের সিন্ডিকেট দায়ী। নানা অজুহাতে তারা সাধারণ ভোক্তাদের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারি সংস্থাগুলোর যথাযথ তদারকি করা উচিত।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বড় একটি ভোজ্যতেল আমদানিকারক গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক বলেন, বন্দর দিয়ে এখন যেসব তেল আমদানি হচ্ছে, তার ঋণপত্র বিশ্ববাজারে ১৫০০ ডলারের আমদানি করা। এখন আন্তর্জাতিক বাজারের দাম প্রতি টন ১৪০০ ডলারের ঘরে বুকিং হচ্ছে। তবে দেশে প্রতি ডলারের বিনিময় হার বেড়েছে। ডলার রেট কমলে দাম কমবে। তখন হয়ত দাম সমন্বয় করে সেল করা হবে। কারণ রেট তো বেশিদিন ধরে রাখা সম্ভব নয়। এখন বাজারের সবার স্টক ভালো আছে।

সূত্রমতে, দেশের ভোজ্যতেলের বাজারের চাহিদা ২০ থেকে ২২ লাখ টন। এর বিপরীতে সারাবছরে আমদানি হয় ৩০ থেকে ৩৩ লাখ টন। মধ্যে পাম অয়েল ১৮ টন এবং সয়াবিন ১২ লাখ টন। এসব চাহিদার সিংহভাগ তেল সরবরাহ করে সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, বাংলাদেশ এডিবল, এস আলম গ্রুপ ও বসুন্ধরা গ্রুপ। 

এ বিষয়ে এস আলম ভেজিটেবল অয়েল লিমিটেডের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) কামরুল হুদা বলেন, ভ্যাট আরোপ করায় বাজারে এখন সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বাড়তির দিকে। এতোদিন আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট ১৫ শতাংশের পরিবর্তে ৫ শতাংশ কার্যকর ছিল। এখন আবার ১৫ শতাংশে ফিরে গেছে। আর চাহিদাও তেমন নেই। তাই সরবরাহও কম, দামও বাড়তির দিকে। 

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, চট্টগ্রাম কার্যলয়ের উপপরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহ বলেন, বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট ও বেশি দামে বিক্রির বিষয়ে আমরা জেনেছি। এ বিষয়ে অভিযান পরিচালনার জন্য আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি। শিগগিরই আমরা অভিযানে নামব।  

বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের মনিটরিং অফিসার (অতিরিক্ত উপপরিচালক) মুহাম্মদ শফিকুল হক আকন্দ বলেন. তেলজাতীয় ভোগ্যপণ্য আমদানি নয় দেশে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিই পারে সব সংকট ও মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ। দেশে উৎপাদন হলে এসব পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে। এতে কমবে আমদানি ব্যয়। সাশ্রয় ও আয় হবে বৈদেশিক মুদ্রা।

প্রতিনিধি/এইচই

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর