শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

‘ডায়রিয়া বন্ধে’ ম্রোদের স্বপ্নে পাওয়া বাঁশি!

সুফল চাকমা
প্রকাশিত: ০১ এপ্রিল ২০২২, ১২:১১ পিএম

শেয়ার করুন:

‘ডায়রিয়া বন্ধে’ ম্রোদের স্বপ্নে পাওয়া বাঁশি!

পার্বত্য চট্টগ্রামের ম্রো জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান অনুসঙ্গ হলো বাঁশি। বিভিন্ন উৎসব পার্বণে দল বেঁধে বিশেষ ধরণের এই বাঁশি বাজায় তারা। তাদের বাঁশি তৈরি ও বাজানোর ব্যাপারে একটি রুপকথার গল্প শোনা যায়। 

এই বাঁশির ইতিহাস সম্পর্কে ম্রো ভাষার লেখক ও গবেষক ইয়াং আঙ ম্রো বলেন, শত শত বছর আগে একদিন এক ম্রো গ্রামে ডায়রিয়ায় একের পর এক মানুষ মারা যাচ্ছিলো। বৈদ্য-কবিরাজী কোনো ওষুধেই কাজ হচ্ছিলো না। তখন গ্রামের এক বয়োজ্যোষ্ঠ ব্যক্তি স্বপ্নে দেখলেন যে এরকম বাঁশি তৈরি করে ১২-২৪ জন যদি দলবেঁধে বাঁশি বাজিয়ে পুরো গ্রাম ৭ বার ঘোরা হয়। তাহলে এই রোগ থেকে গ্রামবাসী রক্ষা পাবে।  তখন সেই ব্যক্তি গ্রামের সবাইকে স্বপ্নের কথা জানালেন কিন্তু গ্রামের লোকজন বিশ্বাস না করে সবাই হাসাহাসি করতে লাগল। বয়োজ্যেষ্ঠ ওই ব্যক্তি নাছোড়বান্দা। তিনি কাউকে না বলে আপন মনে স্বপ্নে যেরকম দেখেছেন ঠিক সেই রকম বাঁশি তৈরি করতে লাগলেন। বাঁশি তৈরি শেষে নিজেই বাঁশি বাজিয়ে পুরো গ্রাম ৭ বার প্রদক্ষিণ করলেন। অলৌকিকভাবে তারপরদিন থেকে ডায়রিয়ার প্রকোপ কমে গিয়ে মানুষের মৃত্যুও বন্ধ হলো। তখন থেকেই ম্রো জনগোষ্ঠী বিভিন্ন উৎসব-পার্বনে শুভ হিসেবে দল বেঁধে বাঁশি বাজায়। যেমন গৌহত্যা উৎসবে, নবান্ন উৎসবে, সামাজিক উৎসব চাংক্রানের সময়, কিংবা পাড়া-গ্রামে নতুন অতিথি আগমনে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দল বেঁধে বাঁশি বাজিয়ে অতিথিকেও বরণ করেন করেন তারা।


বিজ্ঞাপন


এই বাঁশি ছোট, মাঝারি, বড়— বিভিন্ন সাঁইজের আছে। বাঁশিগুলোর নামও আলাদা আলাদা। ছোট বাঁশির নাম— প্লুং কেসা, মাঝারি বাঁশির নাম— প্লুং প্লাংসা। আর বড় বাঁশির নাম— প্লু কাকমা। সুর মেলানোর জন্য টিং টেং প্লু নামের একটি আর শুধু গানের জন্য রিনা প্লু নামের একটি বাঁশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাজানো হয়। বাঁশি তৈরিতে সাধারণত বিভিন্ন সাইজের ছোট-বড় বাঁশ, জুমের লাউয়ের খোল, মোম, বেত আর একধরণের বড় সাইজের বাঁশ লাগে।

জানা গেছে, বড় সাইজের বাঁশি তৈরিতে সাতশ’ থেকে আটশ’ টাকা খরচ হয়। ছোট সাইজের বাঁশি তৈরিতে খরচ আরও বেশি লাগে; পরিশ্রমও বেশি করতে হয়। বাঁশির দলে কমপক্ষে ১২ জন, সর্বোচ্চ ২৪ জন থাকেন।  ১২ জন নাহলে তাল লয় মিলে না। ২৪ জন হলে খুব ভালো হয়।

ইয়াং আঙ ম্রো আরও বলেন, ম্রো সমাজের অন্যতম ঐতিহ্য বাঁশি। এই বাঁশি দেখলেই বুঝা যাবে এই লোকজন কোন জনগোষ্ঠীর। এটি একটি জাতীর পরিচয় বহন করে। 

তবে এই বাঁশির ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, বর্তমান প্রজন্ম এই বাঁশির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। নিজেরা বাঁশি তৈরি ও বাঁশি বাজানো শিখছে না।


বিজ্ঞাপন


বাট্ট্যা পাড়ার বাসিন্দা রেংওয়ান ম্রো বান্দরবান সরকারী কলেজে ইতিহাস বিষয়ে ১ম বর্ষের ছাত্র। তিনি বলেন, ‘বাবা ক্রাতপুং ম্রো এই বাঁশি তৈরি করতে এবং বাঁজাতে জানেন, কিন্তু আমি কোনোটাই পরি না।’ 

তুলা ছড়ি গ্রামের বাসিন্দা মেনচিং ম্রোও (৬২) এই বাঁশি হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেন ৫০ বছর ধরে ম্রো সমাজের বিভিন্ন উৎসব পার্বনে দল বেঁধে বাঁশি বাজাচ্ছি, কিন্তু আধুনিক ম্রো সমাজের তরুণ প্রজন্ম কেউই বাঁশি বানানো কিংবা বাজানো কোনটাই শিখতে আগ্রহী না। তাই শুধু বাঁশি নয় অন্যান্য অনেক ঐতিহ্যই ম্রো সমাজ থেকে হারিয়ে যাবে, বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

বান্দরবান ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনষ্টিটিউট-এর পরিচালক মংনু চিং বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে বান্দরবানের সব সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতির সরঞ্জাম, বাঁশিসহ যেগুলো তৈরি করা যায়, সেগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য অভিজ্ঞদের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। গত বছরও ২৫ জন ম্রোকে রামরি পাড়ায় বান্দরবান ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট এর পক্ষ থেকে ম্রো জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী এই বাঁশি বানানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। 

এএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর