রোববার, ১৯ মে, ২০২৪, ঢাকা

রানা প্লাজায় আহত ‘হাওয়া’ এখন পথের ভিখারি

আহমাদ সোহান সিরাজী
প্রকাশিত: ২৪ এপ্রিল ২০২৩, ১০:৪৮ এএম

শেয়ার করুন:

রানা প্লাজায় আহত ‘হাওয়া’ এখন পথের ভিখারি

রানা প্লাজা ধসে আহত হয়ে কাতর হাওয়া বেগম নামের এ নারী দু’চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে চাকরি নিয়েছিলেন রানা প্লাজায়। সেই স্বপ্নই যেন আজ তাঁর কাঁধে তুলে দিয়েছে ভিক্ষার ঝুলি। প্রতিদিন অসুস্থ শরীর নিয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ফুট ওভারব্রিজে এসে বসেন। ভিক্ষা করে যা হয় তা নিয়ে কষ্টে দিনযাপন করছেন তিনি। ধসে পড়া রানা প্লাজার নয় তলায় ক্লিনার পদে চাকরি করতেন হাওয়া বেগম। কিন্তু ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঘটে যাওয়া শিল্প ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে রানা প্লাজার কংক্রিটের চাপায় নিষ্পেষিত হয় হাওয়া বেগমের স্বপ্ন।

এখন হাওয়া বেগমের সারাদিন কাটে সাভার বাসস্ট্যান্ডের বিভিন্ন ফুটওভার ব্রিজ, মসজিদ ও শপিং কমপ্লেক্সের সামনে ভিক্ষাবৃত্তি করে।


বিজ্ঞাপন


ঈদের আগেরদিন তার সঙ্গে দেখা হয় সাভারের নিউমার্কেট এলাকার ফুটওভার ব্রিজের ওপর। প্রচন্ড গরমে রোজা রেখে একটি কালো বোরকা পরিহিত অবস্থায় সেখানে বসে হাত পেতে ভিক্ষা চাচ্ছেন মানুষের কাছে।

সেখানেই হাওয়া বেগমের সঙ্গে কথা হলে ঢাকা মেইলকে বলেন, রানা প্লাজা ট্র‍্যাজেডির নয় মাস পূর্বে তিনি কুষ্টিয়ার গ্রামের বাড়ি থেকে সাভারে এসে রানা প্লাজার নবম ফ্লোরে ক্লিনার হিসেবে চাকরি নেন। স্বামী স্ত্রী দুজনের ইনকামে ভালোই কাটছিল তাদের দিনগুলো। কিন্তু ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল হঠাৎই যেন তার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার অমানিশা। সেদিন সকালে প্রতিদিনের ন্যায় কর্মক্ষেত্রে যান হাওয়া বেগম। এর কিছুক্ষণ বাদে কিছু বুঝে উঠার আগেই হঠাৎ বিকট শব্দে ভেঙে পরে তার মাথার উপরের ছাদ এতে কংক্রিটের স্তুপের নিচে চাপা পড়েন তিনি। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি সেখানে আটকে থাকার পর আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হয়।

তিনি জানান, ভবন ধসে চাপা পড়ে তার দু’হাত, দুই হাটু ও মেরুদণ্ডে আঘাত মারাত্মক আঘাত পান। এখন কোনো রকমে হাঁটাচলা করতে পারলেও কোন ভারি কাজ করতে পারেন না। তাই কেও তাকে বাসা বাড়িতে ঝিয়ের কাজেও রাখে না। ঘরে তার প্যারালাইজড স্বামী, বৃদ্ধ বাবা-মা এবং অসুস্থ ছোট কন্যা সন্তান। তাই বাধ্য হয়ে আয়ের কোনো পথ না পেয়ে কাধে তুলে নিয়েছেন ভিক্ষার ঝুলি। আর সেই ভিক্ষার টাকাতেই সাভারের কলমা এলাকায় স্থানীয় শহিদের বাড়িতে ভাড়ায় বসবাস করে কোনো মতে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছেন।

হাওয়া বেগম আরও বলেন, অনেকেই তো অনেক কিছুই পেয়েছে। কিন্তু আমি তেমন কোনো সহযোগিতা পাইনি। কেবল চাকরির বেতন বাবদ ৬ হাজার টাকা এবং পরবর্তীতে ব্র‍্যাকের কাছ থেকে এককালীন ৬০ হাজার টাকা সহায়তা পেয়েছিলাম। সেই টাকা দিয়ে আমার নিজস্ব কিছু ঋণ ছিল সেটি পরিশোধ করি আর বাকি টাকা দিয়ে একটি অটোরিকশা কিনে ভাড়া দিয়েছিলাম। কিন্তু সেটিও কিছুদিন বাদে নষ্ট হয়ে যায় ঠিক করতে অনেক টাকা খরচ হবে তাই সেটি বিক্রি করে দিয়েছি। এখন আমি পথের ভিখারি। গ্রামের বাড়ি থাকার মতো কোন ঘর নেই। প্রতি বছরই রানা প্লাজা দিবস এনে কতজন আসে আমাদের ইন্টারভিউ নিতে কিন্তু কেউ কোনো সাহায্য করে না, তাই আমাদেরও কোন ব্যবস্থা হয় না। যেই অবস্থায় আছি সেখানেই থাকি কোন উন্নতি নাই। আমি সরকারের কাছে দাবি জানাই আমরা যারা রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এখন পথে পথে ঘুরছি তাদের জন্য যেন একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেন।


বিজ্ঞাপন


রানা প্লাজার আহত শ্রমিকদের সংগঠন রানা প্লাজা সার্ভাইভার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাহমুদুল হাসান হৃদয় ঢাকা মেইলকে বলেন, আমার জানা মতে রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় ১০/১২ জন শ্রমিক বর্তমানে ভিক্ষা করে তাদের জীবন চালাচ্ছেন। কিন্তু পর্যাপ্ত সহযোগিতা পেলে তারা হয়তো আজ ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে রাস্তায় নামতেন না। রানা প্লাজা তাদের সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। মানুষের সব চেয়ে বড় সম্পদ তার কর্মক্ষমতা সেটি হারিয়ে আজ তারা পথের ফকির। আমরা তাদের জন্য পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ বাস্তবায়নের দাবি জানাচ্ছি।

গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সারোয়ার হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, শুধু হাওয়া বেগমের স্বপ্নই ভঙ্গ হয়নি এই রানা প্লাজায় অসহায়ত্ব আর পঙ্গুত্ব নিয়ে অনেকেই বয়ে বেড়াচ্ছে দুঃসহ স্মৃতি। আহত হয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়ে  এখন তারা ভিক্ষাবৃত্তি করছেন এটা আমাদের জন্য দারুণ কষ্টের ব্যাপার। শ্রমিকদের নিয়ে দীর্ঘদিনের কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি তাদের চাহিদা খুবই অল্প। কেবল একটু খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারলেই তারা খুশি। রানা প্লাজায় কাজ করা অনেক শ্রমিক আহত হয়ে তাদের কর্মক্ষমতা হারিয়েছে। তাই অনেক বাধ্য হয়ে রাস্তায় নেমেছেন। আমরা চাই যারাই বাধ্য হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি শুরু করেছেন তাদের পুনর্বাসন করে এই অভিশাপ থেকে যেন মুক্তি দেওয়া হয়।

প্রতিনিধি/ এজে

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর