ঈদ মানে আনন্দের জোয়ার। ঈদ মানে খুশির সঞ্চার। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর রমজানের শেষ দিনে আকাশের এক কোণে বাঁকা চাঁদের মিষ্টি হাসি ঈদের জানান দেয়। আর একটু ঘোরাঘুরি ভ্রমণ পিপাসুদের এই ঈদ আনন্দে বাড়তি মাত্রা যোগ করে।
ঈদের ছুটিতে পরিবারের সবাই মিলে বেড়াতে যাওয়ার মজাই অন্যরকম। তাই এই ছুটিতে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঘুরতে আসতে পারেন প্রকৃতিকন্যা সিলেটে।
বিজ্ঞাপন
সিলেট প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি। এখানে বেড়ানোর জায়গার যেন শেষ নেই। উঁচু-নিচু পাহাড়ে ঘেরা সিলেটের ঢেউ খেলানো চা-বাগান নিমিষেই পর্যটকের মন কেড়ে নেয়।
সিলেটের সবুজ-শ্যামল রূপ, নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও জীবন প্রবাহে মুগ্ধ হয়ে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, মমতাহীন কাল স্রোতে/বাঙলার রাষ্ট্রসীমা হতে/নির্বাসিতা তুমি,/সুন্দরী শ্রীভূমি।
দেখার মতো অনেক স্থাপনাও রয়েছে সিলেট নগরের মধ্যেই। তার মধ্যে অন্যতম ঐতিহাসিক কিন ব্রিজ, আলী আমজাদের ঘড়ি, চাঁদনি ঘাটের সিঁড়ি, হজরত শাহজালাল (রহ.) ও শাহ পরানসহ (রহ.) ওলি আউলিয়াদের মাজার, খাদিমনগর জাতীয় উদ্যান, শাহী ঈদগাহ, গৌড় গোবিন্দের টিলা প্রভৃতি।
জাফলং, লালাখাল, শ্রীপুর, জৈন্তাপুর, রাতারগুল, জকিগঞ্জে তিন নদী সুরমা-কুশিয়ারা-বরাক মোহনা, জৈন্তিয়া রাজবাড়ী, বিছানাকান্দি, সাদাপাথর ছাড়াও দেখার মতো অনেক কিছুই রয়েছে এখানে।
বিজ্ঞাপন
চা বাগান, বন, স্বচ্ছ পানির নদী, ঝরনা সবকিছু মিলে সিলেট ছুটি কাটানোর আদর্শ জায়গা। ভ্রমণপিয়াসিদের কাছে সিলেটের প্রথম আকর্ষণ চা–বাগান। বাংলাদেশের মোট ১৬৩টি চা–বাগানের মধ্যে ১৩৫টি রয়েছে বৃহত্তর সিলেটে। এর মধ্যে সিলেট জেলার জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও সিলেট সদর উপজেলায় রয়েছে বেশ কয়েকটি চা বাগান। উপমহাদেশের প্রাচীনতম চা–বাগানগুলোর অন্যতম মালিনীছড়া রয়েছে সিলেটে।
ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে সিলেটের পর্যটন স্পটগুলোতে এখন সাজ সাজ রব। পর্যটক আকর্ষণে ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে ধোয়ামোছা আর সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ।
ঈদের দিন থেকে পর্যটকদের জমজমাট আগমন আশা করছেন পর্যটন কর্তৃপক্ষ। সবুজ সুনিবিড় সৌন্দর্য উপভোগ করতে অনেকেই ঈদের ছুটিতে ছুটে আসবেন সিলেটের অনিন্দ্য সুন্দর পর্যটন স্পটগুলোতে।
জৈন্তিয়া পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্য, জাফলংয়ের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য, রাতারগুলের জলারবন, পানতুমাইয়ের ঝরনাধারা, বিছনাকান্দি ও সাদাপাথরের স্বচ্ছ জলের হাতছানি, লোভাছড়ার মন মাতানো সৌন্দর্য আর সারি সারি পাথরের স্তুপ পর্যটকদের টেনে আনে বার বার।
আসুন জেনে নেই সিলেটের বিখ্যাত কিছু পর্যটন স্পট সম্পর্কে-
জাফলং: সুদৃশ্য পাহাড় চূড়া, স্বচ্ছ জলরশি আর নানান রঙের নুড়ি পাথরের এক অপূর্ব সমন্বয় সিলেটের জাফলং। নগর সভ্যতার যান্ত্রিক কোলাহল ছেড়ে জীবন এখানে এসে মাথা লুকোয় একটু শান্তির খোঁজে। প্রকৃতির মায়াবী পরশে আনন্দে নেচে ওঠে মন। তাই ঈদের ছুটিকে পরিপূর্ণ করে তুলতে যে কেউ আসতে পারেন পাহাড়, পানি ও পাথরভরা রূপকথার রাজ্য জাফলংয়ে।
প্রকৃতি কন্যা হিসেবে সারাদেশে এক নামে পরিচিত সিলেটের জাফলং। খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত জাফলং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি।
পিয়াইন নদীর তীরে স্তরে স্তরে বিছানো পাথরের স্তুপ জাফলংকে করেছে আকর্ষণীয়।
সীমান্তের ওপারে ভারতীয় পাহাড়-টিলা, ডাউকি পাহাড় থেকে অবিরাম ধারায় প্রবাহমান জলপ্রপাত, ঝুলন্ত ডাউকি ব্রিজ, পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ হিমেল পানি, উচুঁ পাহাড়ের গহীন অরণ্য ও প্রকৃতির শুনশান নীরবতা পর্যটকদের দারুণভাবে মোহাবিষ্ট করে। তাই যান্ত্রিক সভ্যতার সকল ব্যস্ততা ভুলে গিয়ে কিছুটা সময়ের জন্য হলেও প্রকৃতির কাছে নিজেকে সপে দিতে প্রতিদিনই দেশি-বিদেশি হাজারো পর্যটক ছুটে আসেন প্রকৃতিকন্যা জাফলংয়ে।
প্রকৃতি কন্যা ছাড়াও বিউটি স্পট, পিকনিক স্পট, সৌন্দর্যের রানিসহ বাহারী নামে পর্যটকদের কাছে পরিচিত জাফলং। ভ্রমণ পিয়াসীদের কাছে জাফলংয়ের আকর্ষণ যেন সম্পূর্ণ আলাদা। তাই সিলেট ভ্রমণে আসলে জাফলং না গেলে ভ্রমণই যেন অপূর্ণ থেকে যায়।
বিছানাকান্দি: বিছানাকান্দির স্বচ্ছ জলে ছড়িয়ে আছে সফেদ রূপের বাহার। পাথর-কণায় লুকিয়ে থাকা জলতলের সৌন্দর্য মেলে ধরেছে প্রকৃতি। পাথর ছুঁয়ে ধেয়ে নামছে মেঘালয়-চেরাপুঞ্জি পাহাড়ের স্বচ্ছ জল। সেই জলে বাসা বেধেছে পাথর। সঙ্গে নুড়িকণা। আশ্চর্য করা এই সৌন্দর্য সিলেটের গোয়াইঘাট সীমান্তের বিছানাকান্দিতে।
লালাখাল: জাফলং যাওয়ার পথে জৈন্তাপুর উপজেলার সারিঘাটের কাছেই অবস্থিত লালাখাল। নির্জন মনকাড়া লালাখালের স্বচ্ছ নীল জলরাশি আর দুই ধারের অপরূপ সৌন্দর্য, দীর্ঘ নৌ-পথ ভ্রমণের সাধ যেকোনো পর্যটকের কাছে এক দুলর্ভ আকর্ষণ।
ভারতের চেরাপুঞ্জির ঠিক নিচে লালাখালের অবস্থান। চেরাপুঞ্জি থেকে এ নদী বাংলাদেশে প্রবাহিত। এবার ঈদে লালাখালে ভিড় থাকবে পর্যটকের।
রাতারগুল: সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নে অবস্থিত বাংলাদেশের একমাত্র ‘সোয়াম্প ফরেস্ট’ (জলাবন) রাতারগুল। চারদিকে নদী ও হাওর বেষ্টিত এ বনের বেশির ভাগ এলাকাজুড়ে রয়েছে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা হিজল-করচ গাছ। ‘সিলেটের সুন্দরবন’ খ্যাত প্রায় ৩৩১ একর আয়তনের রাতারগুল বনে বর্ষাকালে পর্যটকদের ভিড় ব্যাপকভাবে লক্ষ করা যায়।
পানতুমাই: বাংলাদেশের কোল ঘেঁষে প্রতিবেশী ভারতের মেঘালয়ের গহীন অরণ্যের কোলে বাংলাদেশ পানে নেমেছে অপরূপ এক ঝরনাধারা। সুউচ্চ পাহাড় থেকে নেমে আসছে জলরাশি। সফেদ জলধারা লেপ্টে আছে সবুজ পাহাড়ের গায়ে। দেখলে মনে হবে সবুজের বুকে কেউ হয়তো বিছিয়ে রেখেছে সাদা শাড়ি।
ভারতের মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে আসা এই ঝরনাধারাটি স্থানীয়ভাবে মায়ামতি ও ফাটাছড়া ঝরনা হিসেবে পরিচিত। আর পর্যটকদের কাছে জলপ্রপাতটির পরিচিতি ‘পাংথুমাই ঝরনা’ নামে।
লোভাছড়া: সীমান্তের বড় বড় পাহাড় ছুঁয়ে নেমেছে ঝরনা। চারদিকে সবুজ বেষ্টিত চা বাগান, সারি সারি গাছ, পাহাড় আর বালু সমৃদ্ধ স্বচ্ছ পানির বহমান নদী। অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে প্রাকৃতিক নৈসর্গের আরেক রূপ। নাম ‘লোভাছড়া’। সিলেটের সীমান্তবর্তী কানাইঘাট উপজেলায় অবস্থিত মনোমুগ্ধকর অপূর্ব এই সৃষ্টি। প্রকৃতি যেখানে তারে সৌন্দর্যের মোহ ছড়ায়! রাঙ্গামাটির মতোই একটি ঝুলন্ত ব্রিজ রয়েছে এই লোভাছড়ায়। ব্রিজটি নির্মিত হয় ১৯২৫ সালের এপ্রিল মাসে।
মালনীছড়া চা বাগান: ওপরে বড় বড় ছায়া বৃক্ষ। নিচে আধো আলো আধো ছায়ায় দুটি পাতা একটি কুঁড়ির সবুজ চাদর। যেন শৈল্পিক কারুকাজ। সিলেটের চা-বাগানের এ প্রাকৃতিক দৃশ্য পর্যটকের মন ছুঁয়ে যায়।
১৫০০ একর জায়গার ওপর অবস্থিত উপমহাদেশের প্রথম চা বাগান মালনীছড়ায় পর্যটকদের কাছে আরেক বিষ্ময়। সিলেটের চায়ের রঙ, স্বাদ এবং সুবাস অতুলনীয়। বর্তমানে বেসরকারি তত্ত্বাবধানে চা বাগান পরিচালিত হয়ে আসছে।
চা বাগানের পাশাপাশি বর্তমানে এখানে কমলা ও রাবারের চাষ করা হয়। এই বাগানের পাশেই বিশ্বের অন্যতম সুন্দর স্টেডিয়াম। যেখানে ২০১৪ সালের বিশ্ব টি-২০ খেলা অনুষ্ঠিত হয়।
মালনীছড়া চা বাগান ছাড়াও সিলেটে লাক্কাতুরা চা বাগান, আলী বাহার চা বাগান, খাদিম আহমদ টি স্টেট, লালাখান টি স্টেট, বরজান টি স্টেট তারাপুর, দলদলি, খাদিম, বড়জান, আলী বাহার, হাবিবনগর, আহমদ টি এস্টেট, খান চা বাগান, লালাখাল টি এস্টেট, শ্রীপুর চা বাগান, মুলাগুল চা বাগান ইত্যাদি।
এছাড়াও সিলেটের শাহজালাল(র.) এবং শাহপরান (র.) এর মাজার এবং নাজিমগড় রিসোর্ট, জাকারিয়া সিটি, সিলেট নগরীর শেখ ঘাটে ঐতিহ্যবাহী জিতু মিয়ার বাড়ি, ঐতিহ্যবাহী ক্বিন ব্রিজ, টিলাগড়ে অবস্থিত এমসি কলেজসহ অন্যন্য পর্যটন কেন্দ্রও ঘুরে দেখতে পারেন। তাই ঈদের ছুটিতে এবার না হয় চলুন সিলেটে।
প্রতিনিধি/ এজে

