শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

‘ভাইয়ের রক্তাক্ত মুখ আমি ভুলতে পারি না’

জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ২৮ মার্চ ২০২৩, ০৫:৪৯ পিএম

শেয়ার করুন:

‘ভাইয়ের রক্তাক্ত মুখ আমি ভুলতে পারি না’

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সারাদেশের মানুষ বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাক হানাদার বাহিনীর পরাজয়ে উল্লাসিত পুরো বাঙালি জাতি। কিন্তু এমন আনন্দমুখর মুহূর্তে গাজীপুরে একটি বাড়িতে শোকের মাতম। স্বজনহারা কান্নায় পুরো পরিবেশ ভারী। কারণ বিজয়ের মাত্র একদিন আগে জেলার কানাইয়া গ্রামের ওই বাড়ির বড় সন্তানকে হত্যা করেছে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মুখমন্ডল বিকৃত করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় কানাইয়া গ্রামের কৃতি সন্তান শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা বদিউজ্জামান খোকনকে। ক্ষত-বিক্ষত মুখমন্ডল আর শরীর জুড়ে নির্যাতনের সেই ভয়াবহতা এখনও ভুলতে পারেন না স্বজনরা।

কানাইয়া গ্রামে রাজাকার আর পাকবাহিনীর নির্মমতায় প্রিয় বড় ভাই হারানোর স্মৃতি নিয়ে এখনো বেঁচে আছেন ছোট ভাই শহীদুজ্জামান ভূঁইয়া বাবলু। সেইদিনের ভয়াবহতায় এখনো আঁতকে উঠেন  তিনি। 


বিজ্ঞাপন


হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ভাইয়ের এমন রক্তাক্ত মুখ আমি ভুলতে পারি না। এমন তাজা লাশ দেখে মা প্রায় পাগল হয়ে যান।

মঙ্গলবার পড়ন্ত বিকেলে শহীদ বীরমুক্তিযোদ্ধা বদিউজ্জামান খোকনকে নিয়ে কথা হয় তার ছোট ভাই শহীদুজ্জামান ভূঁইয়ার সঙ্গে। এসময় তিনি জানান ভয়াল একাত্তরের স্মৃতিময় নানা কথা। উঠে এসেছে খোকনের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, রাজাকারের ভূমিকা ও শহীদ হওয়ার পুরো বর্ণনা।

শহীদুজ্জামান ভুঁইয়া বলেন, ‘আমার বাবার নাম নুরুজ্জামান ভূইয়া, মা আহম্মদা বেগম।  বড় ভাই খোকনসহ আমরা তিন ভাই, দুই বোন। বাবা কৃষি কাজ করে সংসার সামলাতেন। ১৯৭১ সালে বড় ভাই তখন ঢাকার কায়েদে আজম কলেজের (বর্তমান শহীদ স্মৃতি কলেজ) দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। তখন আমি ৪র্থ শ্রেণিতে পড়ি। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জনসভায় যোগ দিতে খোকন অনেকগুলো বাঁশের লাঠি নিয়ে (রেসকোর্স মাঠ) সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যান। সেখান থেকে ফিরে দেশ স্বাধীনের চিন্তা তার মাথায় ঢুকে। প্রায়ই মাকে যুদ্ধে যাবার কথা বলতেন। বলতেন দেশ স্বাধীন হলে আমরা সম্মানিত হব। পুরো পরিবারকে সরকার সম্মানিত করবে।’

১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিল মাসে পরিবারের কাউকে না জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয় খোকন। আমার এক ফুফাতো ভাইয়ের সঙ্গে  প্রশিক্ষণ নিতে ভারত চলে যান। প্রশিক্ষণ থেকে ফিরে ৩ নং সেক্টরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন । পাক বাহিনীর তৎপরতা শুরু হলে আমার ভাই কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে নৌকা যোগে বাড়িতে আসেন। এসময় তাদের সঙ্গে রাইফেল, গ্রেনেড ছিল।  তিনি পূবাইল, মীরের বাজার সহ আশেপাশের এলাকায় শত্রু নিধনের কয়েকটি মিশনে অস্ত্র হাতে সরাসরি অংশ নেন। আমরা ভূঁইয়া পরিবার ছাড়া স্থানীয় নোয়াব আলী সহ অনেকে শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। তবে আমার ভাইয়ের দেখাদেখি এলাকার আরও ৮ জন মুক্তিযোদ্ধে যোগ দিতে ভারত যান। পরে তারাও এলাকায় পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।


বিজ্ঞাপন


১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর, জয়দেবপুর পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প আক্রমনের জন্য বাঙ্কার খুলে মুক্তিযোদ্ধারা পজিশন নেয়। আক্রমন-পাল্টা আক্রমণ শুরু হলে এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এসময় পেছন থেকে রাজাকার ও তাদের দোসররা আমার ভাইকে ধরে ফেলে। শুক্রবার বিকেলে দেশ স্বাধীন হয়। পরের দিন সবাই বিজয়ের আনন্দ উদযাপন করছিল। আর আমরা অপেক্ষায় ছিলাম, ভাই আসলে আনন্দ করব। সবাইকে আমার ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করি, ভাই কোথায়! কিন্তু কেউ বলে না। এক পর্যায়ে আমরা জানতে পারি, আমাদের ভাই খোকন আর বেঁচে নেই। আমরা পরিবারের সবাই কান্নায় ভেঙে পড়ি। পরে বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা বড় ভাইয়ের মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসেন। এসময় লাশ দেখে আমার মা পাগল প্রায় হয়ে যান।

আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমার ভাইয়ের লাশটা যেন একেবারে তাজা। বুক ও মুখে বেয়নেট দিয়ে চার্জ করা, পুরো শরীরে সিগারেটের ছ্যাকা। বেয়নেট দিয়ে খুঁচানোর কারণে থুতনির মাংস ছিলনা। এসময় আ ক ম মোজাম্মেল হক সান্ত্বনা দিতে গিয়ে আমার মাকে মা বলে সম্বোধন করেন।

পরে আমরা জানতে পারি , জয়দেবপুরে রাজাকার নোয়াব আলীর বাড়ির কাছে যেখানে এখন খাদ্য গুদাম সেখানে একটি বড় গর্ত ছিল। সেই  গর্তের ভেতর পাক হানাদার ও রাজাকাররা আমার ভাইকে নির্যাতন করে হত্যার পর মাটি চাপা দিয়ে রাখে। তবে তার একটি হাত বাইরে বেরিয়ে ছিল যা দেখে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা লাশটি আমার ভাইয়ের বলে শনাক্ত করেন। 

আমার ভাই অনেক মেধাবী ছিলেন। বিজ্ঞান বিভাগে ফার্স্ট ক্লাশ পেয়েছিলেন যোগ করে শহীদুজ্জামান বলেন, অত্যন্ত মেধাবী থাকায়  তাকে ঘিরে বাবা ও পরিবারের অনেক স্বপ্ন ছিল। বাবা কৃষি কাজ করলেও ভাইকে লেখাপড়ার জন্য ঢাকায় পাঠান। তবে ভাইকে হারিয়ে মুষড়ে পড়েন বাবা। স্বাধীনতার পর আমরা ছোট ছিলাম। কৃষি কাজ করে বাবা তখন কোনোমতে সংসার সামলাতেন। ১৯৮৬ সালে মা মারা যান। এরপর ২০০৫ সালে বাবাও মারা যান। বর্তমানে আমরা দুই ভাই চাকরি করছি, সরকার আমাদের ভাতা দিচ্ছে। এভাবেই আমাদের দিনগুলি চলে যাচ্ছে।

আক্ষেপ করে শহীদুজ্জামান বলেন, আমার ভাই দেশ স্বাধীন করতে গিয়ে জীবন দিল। তার স্বীকৃতিস্বরূপ গাজীপুরে কিছু থাকা উচিত ছিল। তার খেতাব প্রাপ্য ছিল। শুধুমাত্র ছায়বীথি এলাকায় তার নামে একটি সড়ক রয়েছে। আমরা চাই তার স্মৃতি সংরক্ষণ করা হোক।

প্রতিনিধি/একেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর