মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

১২ দিনে ৩ বনে ‘রহস্যজনক’ আগুন

পুলক পুরকায়স্থ
প্রকাশিত: ২২ মার্চ ২০২৩, ০৫:২৭ পিএম

শেয়ার করুন:

১২ দিনে ৩ বনে ‘রহস্যজনক’ আগুন
ছবি : ঢাকা মেইল

মৌলভীবাজারে গত দুই সপ্তাহে প্রাণ প্রকৃতিতে সমৃদ্ধ তিনটি বনে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এই তিন বন মৌলভীবাজার তথা সিলেট অঞ্চলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চল। প্রথমে ৭ মার্চ পাথারিয়া হিলস্ রিজার্ভ ফরেস্টের বড়লেখা রেঞ্জের সমনভাগ বনে, এরপর ১৫ মার্চ বনাঞ্চলে গ্যাস অনুসন্ধানে ড্রিলিং ও ভূগভর্স্থ বিস্ফোরণে কমলগঞ্জের সংরক্ষিত রাজকান্দি বনে এবং ১৮ মার্চ সন্ধ্যায় কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া বনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

সিলেট বিভাগের যতগুলো বন আছে তার মধ্যে প্রাণ-প্রকৃতিতে সমৃদ্ধ হচ্ছে মৌলভীবাজারের বড়লেখা-জুড়ী উপজেলার পাথারিয়া বন, কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি সংরক্ষিত বন এবং লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। এই বনাঞ্চলগুলোতে পরপর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলোকে রহস্যজনক বলছেন স্থানীয় ও পরিবেশকর্মীরা।


বিজ্ঞাপন


স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মৌলভীবাজারের পাথারিয়া হিলস্ রিজার্ভ ফরেস্টের বড়লেখা রেঞ্জের সমনভাগ বনের আয়তন ১ হাজার ৮০০ একর। এই বনের ধলছড়ি ও মাকাল জোরায় প্রায় ২০ একর বনের গাছ-বাশ উদ্ভিদ লতাপাতা আগুনে পুড়ে ছাই হয়, যদিও বনবিভাগের দাবি সাড়ে চার একর। ফলে বন্য হাতিসহ বন্য প্রাণীর খাবার ও আবাসস্থল ধ্বংস হয়। পরিবেশগতভাবে মিশ্র চিরসবুজ সমনভাগ বনাঞ্চলের এ অংশটি ইন্দো-বার্মা জীববৈচিত্র হটস্পটের একটি অংশ এবং এটি ভারত-বাংলাদেশের আন্তঃসীমান্ত ব্যাপী ছয়টি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যকার একটি। এই এলাকায় ৫টি বন্য হাতির বসবাস রয়েছে।

কমলগঞ্জের রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্ট ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের এই বনকে অনেক গবেষক বন্যপ্রাণীদের 'হটস্পট' বলে অভিহিত করেন। সম্প্রতি এই বনাঞ্চলে গ্যাস অনুসন্ধানে ড্রিলিং ও ভূগভর্স্থ বিস্ফোরণে সংরক্ষিত এই রাজকান্দি বনের সাঙ্গাইসাফি, কাঁঠালকান্দি ও বাঘাছড়া এলাকার তিনটি টিলাভূমি আগুনে পুড়ে ছারখার হয়েছে।

এছাড়াও কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া বনের বাঘমারা ক্যাম্পের অধীনে বন বিভাগের স্টুডেন্ট ডরমিটরির উত্তর-পশ্চিম অংশে হঠাৎ আগুন লেগে আশপাশের প্রায় এক একর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। পরে এলাকাবাসী ও বনকর্মীরা সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন।

পরপর ভিন্ন ভিন্ন এলাকার তিনটি বনে আগুন লাগার ঘটনায় বিষয়ে বনবিভাগ বলছে, এটি বড় কোনো বিষয় নয়, আগুন লাগার ব্যাপারটি একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। তবে স্থানীয়রা বলছেন, বিষয়টি রহস্যজনক। বনবিভাগ নিজেই জড়িত অগ্নিসংযোগে।


বিজ্ঞাপন


পরিবেশকর্মী ওমর ফারুক নাইম বলেন, স্থানীয় বনবিভাগ বনায়নের নামে অর্থ আত্মসাতের জন্য এই কাজ করছে। বন পুড়লে বন বিভাগের কপাল খুলে। প্রাকৃতিক বন আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করার পর সেখানে গড়ে তোলা হয় সামাজিক বনায়ন। প্রকল্প আসে আর লুটপাট হয়। সেই বনায়নের উপকারভোগীদের কাছ থেকে নেয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা।

পরিবেশকর্মী রিপন দে বলেন, বনে বনে আগুন লাগার ঘটনা আমাদের মনকে আহত করেছে, যা অত্যন্ত বেদনার। পার্বত্য এলাকা ছাড়া এত সমৃদ্ধ বন বাংলাদেশে আর কোথাও নাই, যা মৌলভীবাজারে আছে।

সমনভাগ বনে নিয়মিত আসা যাওয়া করেন স্থানীয় বাসিন্দা ইদ্রিস আলী ও কামাল আহমদ। তারা জানান, আগুনের তীব্রতা বেশি থাকায় বনের অনেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। পরে বিষয়টি বন বিভাগকে জানালেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। যার ফলে এখানকার বিভিন্ন বিরল প্রজাতির প্রাণীসহ পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। সব বন খেকোরা খেয়ে ফেলছেন। বনে হাতিও থাকে না। কারণ থাকার কোনো পরিবেশ নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও বন্যপ্রাণী গবেষক মুনতাসির আকাশ জানান, রাজকান্দি সংরক্ষিত বনে ক্যামেরা ট্র্যাপের মাধ্যমে গবেষণা করে দেখা যায়, এখানে এশীয় কালো ভালুক, বন-ছাগল, সোনালী বিড়াল, ছোট নখযুক্ত ভোঁদড়সহ প্রায় ৪০ ধরনের স্তন্যপায়ী প্রাণী, প্রায় ৩০০ প্রজাতির পাখির আবাস। এত সমৃদ্ধ এই সিলেট বিভাগে কমই আছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) মৌলভীবাজারের সাধারণ সম্পাদক শিব প্রসন্ন ভট্টাচার্য্য জানান, গত বছরও আমরা বনে আগুন লাগার একই সংবাদ পেয়েছি কিন্তু তখন যারা দায়িত্বে ছিল তারাই এই কাজ করেছিল বলে জেনেছিলাম। যেহেতু তারা এখনো বর্তমান আছে তাই এই কাজ যে তাদের দ্বারাই হয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। বনবিভাগ নতুন বনায়নের করে আর্থিক সুবিধা নিতে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করছে, তা দুঃখজনক।

বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, বনে আগুন লাগার বিষয়টি জেনেছি। যেহেতু সংরক্ষিত বন এলাকায় আগুন লেগেছে, এতে সরীসৃপ প্রজাতির প্রাণীসহ বিভিন্ন কীটপতঙ্গ, পাখির বাসার ব্যাপক ক্ষতি হবে। এছাড়াও ভাল্লুক, বনছাগল সহ বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণীর উল্লেখযোগ্য আবাসস্থল রাজকান্দি বনাঞ্চল। সেখানে ড্রিলিং ও শুটিং করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কোনো কারণে যদি মাগুরছড়ার মতো দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে আরও মারাত্মক হবে।

এদিকে পাথারিয়া বনাঞ্চলে আগুন লাগার ঘটনাটি তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই ঘটনায় বন বিভাগের সমনভাগ বিটের কর্মকর্তা নুরুল ইসলামকে প্রত্যাহার করে সিলেট অফিসে সংযুক্ত করা হয়েছে। এছাড়াও গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও তা এখনও জমা হয়নি। তবে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তদন্ত কাজ শেষে প্রতিবেদন প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে।

তদন্তে ১ দশমিক ৮৫ হেক্টর বন পুড়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া ছাড়াও কোনো দুস্কৃতিকারীরা জবর-দখলের উদ্দেশ্যে বনে আগুন লাগাতে পারে বলে ধারণা করছেন জানিয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান সহকারী বন সংরক্ষক (শ্রীমঙ্গল) মারুফ হাসান সোমবার (২০ মার্চ) রাতে বলেন, আমাদের তদন্ত কাজ শেষ হয়েছে। প্রতিবেদনও প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রতিবেদন এখনও অফিসিয়ালি জমা দেওয়া হয়নি।

প্রতিনিধি/এজে

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর