কৃষক আবু সাঈদ পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি বেগুন বিক্রি করে পেয়েছেন ১০ টাকা। সেই বেগুন হাত ঘুরে হয়ে যাচ্ছে ৩০-৪০ টাকা। একইভাবে তিন-চার গুণ থেকে আরও বেশি হয়ে যাচ্ছে সব ধরনের সবজির দাম।
নওগাঁর হাটবাজারগুলোতে ইতোমধ্যে গ্রীষ্মকালীন সবজি বাজারে উঠতে শুরু করেছে। বাজারগুলোতে চড়া দামে সবজি বিক্রি হলেও কৃষকের লাভ হচ্ছে না। মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। ঠকছেন সাধারণ ক্রেতা ও কৃষক।
বিজ্ঞাপন
বুধবার (১৫ মার্চ) সকাল সাড়ে ৬টায় নওগাঁর বদলগাছী থানার পাশে স্কুলমাঠের পাইকারি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার বিভিন্ন কৃষক ও পাইকাররা সবজি বেচা-কেনা করছেন। স্থানীয় পাইকাররা সবজি কিনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ভোর থেকে বেলা ১০টা পর্যন্ত সবজি কেনাবেচা চলে।
এই বাজারে প্রতি কেজি সাদা বেগুন পাইকারি ১০ টাকা, করলা ৬০ টাকা, পটল ৬০ টাকা, কাঁচা মরিচ ৫০ টাকা, ঢেড়স ৭০ টাকা, প্রতি পিস লাউ ১০-১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সেখানেই আবার বসেছে খুচরা বাজারও, যেখানে প্রতি কেজি সাদা বেগুন ২০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, পটল ৮০ টাকা, কাঁচা মরিচ ৮০ টাকা, ঢেড়স ৯০ টাকা, প্রতি পিস লাউ ২৫-৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
নওগাঁ পৌর খুচরা কাঁচাবাজারে বেগুন ৪০ টাকা, করলা ১২০ টাকা, পটল ৮০ টাকা, কাঁচা মরিচ ১২০ টাকা, ঢেড়স ১০০ টাকা, প্রতি পিস লাউ ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
বদলগাছী উপজেলার চকা-আলম গ্রামের কৃষক আবু সাঈদ ৪ মণ বেগুন নিয়ে এসেছেন বিক্রি করতে। বেগুন বিক্রি করে লাভ হচ্ছে না দাবি করে তিনি বলেন, খুচরা বাজারে বেগুন কিনতে গেলে ২০-২৫ টাকার নিচে পাওয়া যায় না। এই বেগুন আবার ঢাকায় কয়েক গুণ বেশি দামে মানুষ কিনে খায়। বাজারে ফসলের দাম ঠিকই আছে। আমরা বিক্রি করতে গেলে দাম নাই।
সাদিসপুর গ্রামের কৃষক আব্দুর রহিম বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরেই বেগুন চাষাবাদ করছি। বেগুনে কিন্তু খরচ অনেক বেশি হয়। কারণ বেগুন চাষ করতে গেলে বিভিন্ন রোগ-বালাই মোকাবিলা করতে হয়। তাই বেগুনের ফলন ভালো করতে গেলে প্রচুর পরিমাণে ওষুধ স্প্রে করতে হয়। এছাড়া শ্রমও দিতে হয় অনেক। আজ হাটে ২ মণ বেগুন নিয়ে এসেছিলাম, ৩৮০ টাকা মণ দরে বিক্রি করলাম। আমরা কৃষকরা তো দাম পাই না। পাইকারসহ অন্যরা দাম পায়। বেগুনের দাম যদি ১০ টাকা থাকে, তাহলে আমাদের চাষের খরচই উঠবে না।
কুমারপুর গ্রামের কৃষক অলক বলেন, বাজারে ১ মণ বেগুন নিয়ে এসেছিলাম। বেগুনের চেহারা একটু খারাপ হওয়ায় ৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করলাম। এই বেগুনই খুচরা বাজারে ১৫-২০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। চোখের সামনেই এমন করে ঠকতে হয়। পাইকার আর দোকানিরা সবসময় চিন্তা করে কেমন করে কৃষককে ঠকানো যায়।
দাউদপুর গ্রামের কৃষক ওসিত চন্দ্র মন্ডল বলেন, বেগুন বিক্রি করতে আসলে এক মণে ২ কেজি করে বেশি দিতে হয়। এক মণ থেকে ১-২ কেজি বেশি থাকলে সেটাও দিয়ে দিতে হয়। আমাদের খালি কষ্ট করাই সার। যা লাভ পাইকারের আর খুচরা দোকানদারের। বেগুন বিক্রি করে খরচ উঠা তো দূরের কথা সংসার চালানো দায় হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে খুচরা সবজি বিক্রেতা রাসেল বলেন, আজ এই বাজার থেকে বেগুনসহ বিভিন্ন সবজি কিনে এখানে বিক্রি করছি। কত করে কিনেছেন ও বিক্রি করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১০ টাকা কেজি কিনেছি, ২০ টাকা কেজি বিক্রি করছি। এখান থেকে এখানে দ্বিগুণ দামে বিক্রির কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেখেন, আমরা খুচরাভাবে সবজি বিক্রি করি। আর আমাদের বেগুন তো একবারে সব বিক্রি হয় না। রেখে দিয়ে দিয়ে বিক্রি করতে হয়। দেখা যায় ২০ কেজি কিনলাম, পুরোটা বিক্রি না হলে সেখান থেকে কমে যায়। এতে করে আমাদের লস হয়।
আরেক খুচরা বিক্রেতা জয়নাল বলেন, আমি এই বাজার থেকে বেগুন কিনে নওগাঁ শহরের বাজারে বিক্রি করি। হাট থেকে যে দামে বেগুন কিনি তার চেয়ে কেজি প্রতি ৩-৪ টাকা বাড়তি দামে বিক্রি করে দেই। তবে বেগুনের বাজার আগের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। আজকে ভালো বেগুন কিনলাম ১০ টাকা কেজি করে। এর সঙ্গে পরিবহন খরচ মিলিয়ে কেজি প্রতি ৩-৪ টাকা বাড়তি দামে বিক্রি করে দেব।
নওগাঁ পৌর শহরের খুচরা সবজি বিক্রেতা ইসহাক বলেন, কৃষকরা সরাসরি তাদের কাছে ফসল নিয়ে আসেন না। পাইকাররা তাদের মালামাল সরবরাহ করেন। পাইকারি দরের চেয়ে দুই-তিন টাকা বেশি নিয়ে মালামাল বিক্রি করি।
বদলগাছী থানার পাশে স্কুল মাঠে পাইকারি বাজার থেকে বেগুনসহ বিভিন্ন সবজি কিনে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করেন সানোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, এই বাজারসহ উপজেলার বিভিন্ন বাজার থেকে বেগুনসহ বিভিন্ন সবজি কিনে ঢাকায় পাঠাই। আজ হাটে বেগুন কিনলাম ভালোটা ১০ টাকা কেজি। সাথে রয়েছে হাটের খাজনা। এরপর বস্তা খরচ, শ্রমিক খরচ, গাড়ি ভাড়া আছে। আবার ট্রাফিককেও টাকা দিতে হয়। ঢাকায় নিয়ে এই বেগুন আমরা ২০-২৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করি পাইকারদের কাছে। এতে আমাদের কিছুটা লাভ হয়।
প্রতিনিধি/এমএইচএম/জেএম