বগুড়ার আলতাফোননেছা মাঠ ছিল অনেক প্রতিভাবান ক্রীড়াবিদের তীর্থভূমি। এ মাঠে খেলে মাহবুবুর রহমান বড় কালু, সারোয়ার মাষ্টার, আলফাজ আহমেদ গেদা, আবেদুর রহমান নান্টু, আইনুল হক, সাইফুল হক, অমলেশ সেন, ফললুক করিম, ঈসমাইল, সম্রাটের মতো ফুটবলারের জন্ম। যে মাঠ থেকে রাশিদুন নবী অনু, সরফুদ্দিন আহমেদ টুটু, রওনক টুটুল, পপলু, অহীদুল, দুলালের মতো চৌকস ক্রিকেটারের জন্ম। সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার অভাবে অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে সেই মাঠ। এই খেলার মাঠটি এখন পরিণত হয়েছে মেলার মাঠে, রাজনৈতিক জনসভার মাঠ। শুধু হারিয়ে যাচ্ছে উচ্ছল শৈশব ও তারুণ্যের উদ্যম।
বলছিলাম বগুড়া জেলার এ ঐতিহাসিক মাঠটির কথা। শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথা থেকে প্রায় ২ মিনিটের পথ হাঁটলেই জলেশ্বরীতলা রোডে অবস্থিত আলতাফুন্নেসা খেলার মাঠ। এ মাঠটি মূলত নবাব আলতাফ আলী- মোহাম্মদ আলী পরিবারের দান করা সম্পত্তি। এ আলতাফোননেছা নবাবের মেয়ে।
বগুড়ায় ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে খেলার মাঠ। ২ হাজার ৯শ ১৯ বর্গ কিমি আয়তনের এ জেলায় খেলার মাঠের সংখ্যা খুবই কম। মাঠের অভাবে খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিশুরা। শিশুরা হারাচ্ছে তাদের শৈশব, নেই খেলাধুলা করার মতো পরিবেশ।
বিজ্ঞাপন
স্কুলগুলোতে শিক্ষার অন্যান্য সিলেবাসের সঙ্গে খেলাধুলা কথাটি যুক্ত থাকলেও সেটুকুও হচ্ছে না। অধিকাংশ স্কুলে নেই খেলার মাঠ। যেসব স্কুলে আছে সেখানেও ছুটির পর মেইন গেটে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।
মাঠ স্বল্পতার কারণে খেলার ছেলেমেয়েদের নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন অভিভাবক জুনায়ের বারি। তিনি বলেন, এখন আশেপাশে খেলাধুলা করার মতো তেমন পরিবেশ ও মাঠ কোনোটাই নেই। পাশের গ্রামে একটা ছোট মাঠ আছে, কিন্তু বাচ্চাদের সেখানে পাঠাতে আমরা ভয় পাই। প্রতিদিন পত্রিকা, টেলিভিশনে কিশোরগ্যাং, গুম-খুনের ঘটনা অহরহ দেখা যায়। আমাদের বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ নিয়েও আমরা অনিশ্চয়তার মাঝে আছি।
ছেলেমেয়েদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ নিয়ে চিন্তিত আরেক অভিভাবক শিখা রানি। তিনি জানান, এখন ছেলেমেয়েরা মোবাইল ফোনে আসক্ত হয়ে পড়েছে। স্কুল আর প্রাইভেটের সময় ছাড়া প্রায় সবসময়ই মোবাইল ফোন হাতে। বাসায় ঠিকমতো পড়াশোনাও করে না। পড়ার কথা বললেই মাথা ব্যথা, শারীরিক দুর্বলতাসহ নানান অজুহাত দেখায়। ফোন নিয়ে নিলেও রাগ, অভিমান কখনো কখনো না খেয়ে থাকে। বাইরে খেলাধুলা করার মতো পরিবেশ না থাকায় কিছু বলতেও পারি না। এক প্রকার বাধ্য হয়েই বাচ্চাকে ফোন দিতে হয়।
স্কুলে মাঠ সংকটের কারণ জানালেন বগুড়া ইয়াকুবিয়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের শারীরিক চর্চা বিষয়ের শিক্ষিকা রেবা। তিনি জানান, আগের তুলনায় স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় অনেক গুণ বেড়ে গেছে। পাঠদান অব্যাহত রাখার জন্য বাধ্য হয়ে খেলার মাঠেই নির্মাণ করতে হচ্ছে নতুন ভবন। এতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। ফলে বিভিন্ন শিফট আকারে নেওয়া হচ্ছে ক্লাস। ক্লাস চলাকালীন খেলাধুলা করার সুযোগ নেই।
আলতাফোননেছা খেলার মাঠটি শহরের প্রাণকেন্দ্রে হওয়ায় যেকোনো ধরনের ছোট-বড় খেলায় ব্যাপক দর্শক সমাগম হতো। মাঠের কানায় কানায় দর্শক উপস্থিত থেকে খেলা উপভোগ করে বাড়ি ফিরতেন। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় বগুড়ার এ ক্রীড়াঙ্গনে স্থবিরতা বিরাজ করছে। ইতোপূর্বে বহুবার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও মাঠটির অভিভাবক পৌরসভা তা মূলত কার্যকর করেনি।
বিজ্ঞাপন
ঐতিহ্যবাহী এই মাঠটি সংস্কারের আশ্বাস দিয়েছেন পৌরসভার মেয়র রেজাউল করিম বাদশা। এ বিষয়ে পৌর মেয়র বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমরা সকল ধরনের মেলা বসানো বন্ধের নির্দেশ দিয়েছি। মাঠে হোন্ডার গ্যারেজ, খাবারের দোকান, কাপড়ের দোকান বসাতে বারণ করেছি। আমি ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনকে নির্দেশ দিয়েছি মাঠটি সংস্কার করতে। মাটি খেলার উপযোগী করে তুলতে চারপাশের ড্রেন লাইটের ব্যবস্থা দিয়েছি এবং খেলার পরিবেশের জন্য মাটি ঘাস লাগানোর নির্দেশ দিয়েছি। তারা কাজ করছেন। আমি কয়েকদিন আগে মাঠে গিয়েছিলাম, এলাকাবাসীকে বলে এসেছি এই মাটি শুধু পৌরসভার না, এই মাঠটি বগুড়াবাসীর। তাই আপনারাও সহযোগিতা করুন। আমি আশা করি আগামী ছয় মাসের মধ্যে মাটিতে খেলার পরিবেশ সৃষ্টি হবে।'
জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুলতান মাহমুদ খান বলেন, পৌরসভার অবহেলা আর অব্যবস্থাপনার কারণে মাঠটি ঐতিহ্য হারাচ্ছে। এই মাঠে আগে খেলা হতো, এখন এই মাঠে মাসব্যাপী মেলা বসে। কাপড়ের দোকান থেকে শুরু করে ফাস্টফুডের দোকান বসে। খেলাধুলার পরিবেশ নেই। মাঠটি পৌরসভার বদলে জেলা ক্রীড়া সংস্থার কাছে হস্তান্তরের জন্য জেলা প্রশাসনে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
৭ নম্বর ওয়ার্ডের স্থানীয় কাউন্সিলর দেলোয়ার হোসেন পশারী বলেন, নিয়মিত খেলাধুলা করতে না পারলে কিশোর-তরুণদের মাদকসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বেড়ে যাবে। তাই এই আলতাফোননেসা খেলার মাঠটি খেলা উপযোগী করে ধরে রাখার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানায়।
এক সময় ঐতিহাসিক এ খেলার মাঠে পাকিস্থান থেকে কিয়ামারি টিম, ইন্ডিয়ার থেকে কুচবিহার শিলিগুড়িসহ বিভিন্ন প্রদেশ থেকে ফুটবল টিম টুর্নামেন্টে অংশ নিত। স্থানীয় ক্রিকেট লীগে দেশি-বিদেশি জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা খেলে দর্শকদের মন মাতিয়েছে। আজ যেন সবই স্মৃতি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাঠের একমাত্র ওই অফিস ভবন।
বগুড়ার মানুষের দাবি, অনতিবিলম্বে মাঠটির সংস্কারসহ মাঠে খেলার পরিবেশ ফিরে দেওয়া হোক।
প্রতিনিধি/এইচই

