বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

জন্মভিটা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সুনীলের স্মৃতি

বিধান মজুমদার অনি
প্রকাশিত: ২৪ মার্চ ২০২২, ১১:০৯ এএম

শেয়ার করুন:

জন্মভিটা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সুনীলের স্মৃতি

২ রুমের ছোট্ট পাকা বাড়ি। মরিচা পড়া তালায় বন্ধ সে দরজা। উঠানে জমেছে শুকনো পাতা। সামনে একচালা টিনের বারান্দা। তাতে রাখা কিছু পাটখড়ি। দীর্ঘদিনেরে অযত্ন আর অবহেলায় জানালার গ্রিলেও মরিচা ধরেছে। বাসা বেঁধেছে মাকড়সা।

পাশের বাড়ির একজনের সহযোগিতায় খোলা হলো ঘরের দরজা। ঘুরে ঢুকতেই চোখে পড়ে ধুলাবালির আস্তর। একরুমে দুইটি খাট পাতানো। তার উপরেও তেল চিটচিটে বালিশ ও ছেড়া-বিবর্ণ তোষক। পাশের দেয়ালে ঝুলছে একটি পুরনো ছবি। রুমটিতে একটি বাতি থাকলেও নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। পাশের রুমে একটি পুরোনো কাঠের আলমারি। ঘুণ পোকায় যা খেয়ে এরই মধ্যে শেষ করে ফেলেছে। সেকেলের ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট সিনেমার করুণ দৃশ্যপটকেও যেন হার মানায় রঙ খোয়ানো বাড়িটি। 


বিজ্ঞাপন


সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাংলাদেশে, বিখ্যাত হয়েছেন কলকাতায়। তবুও কবি দুই বাংলাকেই এক করে দেখেছেন— এক বাংলা হিসেবে কামনাও করেছেন আমৃত্যু। সুনীলকে নিয়ে কলকাতার যতটা গর্ব, এই অঞ্চলে তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এ অঞ্চলের মানুষ বলেন ‘সুনীল আমাদের’।

sunil

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাংলাদেশে, বিখ্যাত হয়েছেন কলকাতায়। তবুও কবি দুই বাংলাকেই এক করে দেখেছেন— এক বাংলা হিসেবে কামনাও করেছেন আমৃত্যু। সুনীলকে নিয়ে কলকাতার যতটা গর্ব, এই অঞ্চলে তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এ অঞ্চলের মানুষ বলেন ‘সুনীল আমাদের’।

তাই কবির স্মৃতিচিহ্ন রক্ষার্থে মাদারীপুরে তার জন্মভিটায় নির্মাণ করা হয়েছিলো কবির ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিস সংরক্ষণ ও গবেষণাগার। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে স্মৃতিচিহ্নগুলো।


বিজ্ঞাপন


এদিকে, কবির বাড়ির বিদ্যুৎ বিল সময়মতো পরিশোধ না করায় সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে পল্লী বিদ্যুৎ। সুনীল স্মৃতি ক্লাব কমিটি বলছে, কবির বাড়ি দেখভাল করার দায়িত্ব উপজেলা প্রশাসনের, আর উপজেলা প্রশাসন বলছে স্থানীয় কমিটির। এভাবে পরস্পরের দায় চাপানোর আড়ালে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কবির স্মৃতিবিজড়িত এই চিহ্নগুলো। সচেতন মহলের দাবি দ্রুত কবির স্মৃতি সংরক্ষণ করা।

sunil

জানা যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ১৯৩৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার কাজী বাকাই ইউনিয়নের পূর্ব মাইজপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দেশ বিভাগের আগেই কষ্ট আর অভিমান নিয়ে পরিবারের সঙ্গে চলে যান ভারতের কলকাতায়। সেখানেই থিতু হয়েছিলেন মৃত্যু অবধি। কামিয়েছেন সুনাম ও খ্যাতি। কবিতা, উপন্যাস ও প্রবন্ধে মাতিয়েছেন দুই বাংলা।

দেশান্তরী হওয়ার প্রথম এসেছিলেন ২০০৩ সালে। যখন সুনীলের সুখ্যাতি দিকে দিকে। সুনীলের পৈতৃক ভিটাও তখন মানুষের দখলে। প্রবাসী লেখক আ. রাজ্জাক হাওলাদারের সহযোগিতায় উদ্ধার করা হয় কবির জন্মভিটা। তিনি উদ্যোগ নেন তাকে জন্মভিটায় নিয়ে আসতে। কলকাতায় যোগাযোগের পর তিনি নিজের জন্মস্থানে আসতে সম্মতি দেন। তার পদধূলিতে ধন্য হয় মাদারীপুরের মাটি।

sunil

৭৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ২০০৮ সালের ২১ নভেম্বর তিনি এসেছিলেন নিজ গ্রামে। তার জন্মবার্ষিকী ও আগমন উপলক্ষে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। কবি সে আয়োজনে সীমাহীন খুশিও হয়েছিলেন। তখন তিন দিনব্যাপী ‘সুনীল মেলা’ বসেছিল। চারদিকে অফুরন্ত উচ্ছ্বাস ছিল। কবিভক্তদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছিল সেই গ্রাম। নাচ, গান, আবৃত্তি ও নাটক দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন কবি।

তৎকালীন কালকিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ হাফিজুর রহমানের সহযোগিতায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ৭ একর ১৫ শতাংশ জমি দখল মুক্ত করা হয়। পরে সেখানে তিনি একটি পাঠাগার তৈরি করনে। এরপর সেখানে প্রতিবছর মেলা হতো। কিন্তু করোনার পরে আর হয়নি। এরপর থেকেই অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে আছে তার পৈত্রিক বাড়ি ও কবির ব্যবহৃত স্মৃতি চিহ্নগুলো। এমনকি কবির বাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।

sunil

স্থানীয় বাসিন্দা ইউসুফ কাজী বলেন, ‘কবি বেশ কয়েকবার এখানে এসেছিলনে। শেষবার এসে তিন দিন থেকেছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার পরে তার আত্মীয়রা কেউ আসেননি। তার বাড়িটি সরকারিভাবে কেউ দেখাশোনা করে না। এর আগে কারেন্টের লাইন দিয়েছিলো, তাও এখন বিল না দেওয়ায় পল্লী বিদ্যুতের লোকেরা লাইন কেটে দিয়েছে। আমাদের সবার দাবি সরকারিভাবে এই স্থানটির দেখাশোনা করা হোক। যাতে কবির স্মৃতিচিহ্নগুলো সংরক্ষণ করা যায়।’

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ক্লাবের সদস্য বিপ্লব হাওলাদার জানান, কবির বাড়ি ও তার সকল স্মৃতি সংরক্ষণের দায়িত্ব ছিলো উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার, এমনকি এই বাড়িটির বিদ্যুৎ সংযোগও উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার নামে। কিন্তু তারা সংরক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না।

কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও প্রভাষক ইয়াকুব খান শিশির জানান, আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, এতো বড় একজন কথা সাহিত্যিক আমাদের মাদারীপুরে জন্মগ্রহণ করলেও আমরা তার অবস্থান ঠিক রাখতে পারিনি। তার যে পৈত্রিক ভিটা সেটার এখন নাজুক অবস্থা। আমরা চাই, প্রশাসনসহ সকল মানুষ এগিয়ে এসে কবির এই স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ করুক।

sunil

কালকিনি উপজেলা পল্লীবিদ্যুৎ জোনাল অফিসের ডিজিএম আব্দুল মাজেদ বলেন, ‘আমরা বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার আগে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি বকেয়া বিল পরিশোধ করেননি। পরবর্তীতে বকেয়া বিল পরিশোধ করলে আমরা পুনরায় বিদ্যুৎ সংযোগ দিবো।’

কালকিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দিপংকর তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ‘আমি যতোটুকু জানি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মৃতিবিজড়িত পৈতৃক ভিটা সংরক্ষণ করার জন্য বেসরকারিভাবে একটি কমিটি আছে। উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তবে এই কমিটি কতটা সক্রিয় আছে তা জানা নেই। যখন মেলা হয়েছিল, উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় সেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছিলো। এখন কী অবস্থায় আছে তা জানি না। তবে কমিটি চাইলে, আমাদের পক্ষ থেকে সব রকম সহায়তা দেওয়া হবে।’

এইচই/টিবি/এজেড

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর