শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

ফজলি আম আর মন মজায় না!

জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৮ মার্চ ২০২৩, ০৬:১৭ পিএম

শেয়ার করুন:

ফজলি আম আর মন মজায় না!

আন্দোলন করে ফজলি আমের জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন) স্বীকৃতি আদায় করেছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষ। কিন্তু সেই ফজলিই এখন অস্তিত্ব সংকটে ভূগছে। এই জাতের আমের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় বদল করে অন্য জাতের আম চাষ শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা। 

চাষি ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, ফজলি আমের দাম না পেয়ে অন্য আম চাষে নির্ভর হচ্ছেন তারা। তাদের দাবি ফজলি আম আর মন মজায় না।কারণ,পর্যাপ্ত টাকা পায়না। ফজলির জায়গা নিয়েছে অধিক লাভজনক আম্রপালি, কাটিমনসহ অন্যান্য জাতের আম। 


বিজ্ঞাপন


চাষীরা এখন আগাম ও নাবী জাতের আম চাষে ঝুঁকছেন। আমের ভরা মৌসুম হিসেবে বিবেচিত জুন মাসে যে সব আম পাকে সেগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন চাষীরা। 

কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত তিন কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে ফজলি জাতের আম। প্রথমত, নতুন করে আর ফজলির বাগান গড়ে উঠছে না। দ্বিতীয়ত, পুরনো বিশাল বিশাল গাছের উৎপাদন ক্ষমতা কমে গেছে। তৃতীয়ত, সমতুল্য জাত আম্রপালির সঙ্গে বাজারমূল্যের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েছে ফজলি আম।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আম চাষীদের মাঝে সচেতনতা গড়ে না উঠলে ফজলি অলাভজনক অন্যান্য জাতের মতো হারিয়ে যাবে বিখ্যাত আমের রাজধানী  চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে।

শিবগঞ্জ উপজেলার আম চাষী আতাউর রহমান ঢাকা মেইলকে  বলেন, আগের জনপ্রিয় ফজলি জাতটি প্রথম বাণিজ্যিক ধাক্কা খায় কয়েক বছর আগে। তখন চাঁপাইনবাবগঞ্জে কেবল আম্রপালি জাতের সম্প্রসারণ শুরু হয়েছে। আম্রপালি আম পাকে ফজলির সময়ই। আকার ও স্বাদে আকর্ষণীয় হওয়ায় আমপ্রেমীরা ফজলির বিকল্প হিসেবে সাদরে গ্রহণ করেন আম্রপালিকে। তাই এ ফজলি আমের কদর কমেছে। ফলে দামও কমেছে। মাত্র তিন বছর আগে যে ফজলি আম বিক্রি করেছি ৪-৫ হাজার টাকা মণ দরে। আর গত দুই বছর থেকে বিক্রি করছি দেড় থেকে দুই হাজার টাকা মণ দরে। এতে লোকশানে পড়তে হচ্ছে আমাদের। তাই এই আম গাছ কেটে কাটিমন জাতের আম বাগান তৈরি করছি। 


বিজ্ঞাপন


শিবগঞ্জ ম্যাংগো প্রডিউসর কো-অপারেটিভ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল খান শামীম ঢাকা মেইলকে বলেন,জেলায় প্রতি বছর আম বাগান বাড়লেও নতুন করে কেউ আর ফজলির বাগান গড়ে তুলছেন না। অথচ গত এক দশকে বিপুল পরিমাণ জায়গা দখল করে নিয়েছে আম্রপালি, কাটিমনসহ বিভিন্ন জাতের আম। পুরনো যে ফজলির বাগানগুলো রয়েছে সেগুলোও হারিয়েছে উৎপাদন ক্ষমতা। সব মিলিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকেই যাচ্ছে জাতটি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী চাঁপাইনবাবগঞ্জে এই বছর ফজলি আমের চাষ হয়েছে ৭ হাজার ৯৯৫ হেক্টর জমিতে। গাছের সংখ্যা ৫ লাখ ৯১ হাজার। গত কয়েক বছরের ফজলি জাতের কি পরিমাণ গাছ কেটে ফেলা হয়েছে তার পরিসংখ্যান নেই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কাছে। তবে জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বড় বড় গাছ কেটে ফেলার ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে। সবচেয়ে বেশি আম আম গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে শিবগঞ্জ উপজেলায়। এই উপজেলাতেই ফজলির বাগান বেশি। সম্প্রতি শিবগঞ্জের শেখটোলা গ্রামে সাড়ে ১৬ বিঘা আয়তনের একটি ফজলি বাগান কেটে ফেলতে দেখা গেছে। 

স্থানীয়রা জানান, এই বাগানের একেকটি গাছের বয়স দেড়শ বছরের কম নয়। শিবগঞ্জ উপজেলার  ধাইনগর, শাহবাজপুর, হাজারবিঘী, তেলকুপি এলাকাতেও বাগানের বড় গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। এছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার মাহারাজপুর ইউনিয়ন ও বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়ন দেখা গিয়েছে একই চিত্র।

বাগান মালিকরা বলছেন, ৪-৫ বছর আগে থেকেই বাগান কেটে ফেলা শুরু হলেও গত দুই বছরে দেদারসে কাটা হচ্ছে গাছ।

কেন কাটা হচ্ছে গাছ?

আম চাষীরা বলছেন বড় গাছগুলো থেকে আগের মতো আর আম পাওয়া যাচ্ছে না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়েছে গাছগুলো। উৎপাদন কমে যাওয়ায় হতাশা থেকেই কেটে ফেলা হচ্ছে বাগান।

শিবগঞ্জের শেখটোলা গ্রামের আকবর আলী  ও কামাল উদ্দিন  বলেন, ফজলি গাছে আমের উৎপাদন কমে গেছে। এছাড়াও বড় গাছ হওয়ায় পরিচর্যা করতে সমস্যা হচ্ছে বাগানীদের। তাই জেলার আম বাণিজ্যের জন্য অশনী সংকেত হলেও চাষীরা সাময়িক লাভের কথা চিন্তা করে উজাড় করছেন বাগান।

রাকিব নামে এক ব্যক্তি বলেন, ভারত থেকে আসা অবৈধ হরমোন ‘কালটার’অতিরিক্ত মাত্রায় প্রয়োগে ফজলি আম গাছের ক্ষতি হয়েছে। অনেক গাছের কাণ্ড পচে গেছে। তাই কোনো কোনো বাগানে বাধ্য হয়েই কেটে ফেলতে হচ্ছে আম গাছ। বড় গাছে হরমোনের অতিরিক্ত প্রয়োগ বন্ধ হওয়া প্রয়োজন বলেও মনে করেন চাষীরা।

তবে ‘বড় গাছগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়েছে’, চাষীদের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মুনজের আলম মানিক। তিনি বলেন, বড় গাছ চাঁপাইনবাবগঞ্জের সম্পদ। যে হারে বড় গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে আম চাষীদের হা-হুতাশ করতে হবে। তিনি বলেন, একটি বড় গাছ কম জায়গায় অনেক বেশি আম উৎপাদন করে। বড় গাছের সমপরিমাণ জায়গায় ছোট গাছ লাগিয়ে সেই পরিমাণ আম পাওয়া সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোয় সক্রিয় হতে হবে। চাষীরা যাতে গাছ কেটে না ফেলেন সে ব্যাপারে তাদের সচেতন করতে হবে। পাশাপাশি চাষীরা তাদের উৎপাদিত আমের সঠিক মূল্য যেন পান তা নিশ্চিত করতে হবে। সে ক্ষেত্রে আম ভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলার বিকল্প নেই। 

ss

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক পলাশ সরকার  বলেন, চাষীরা এখন আলট্র্যা হাইডেনসিটি (অতি ঘন) বাগানের দিকে ঝুঁকছেন। পাশাপাশি গত এক দশকে ছোট গাছ এমন জাতগুলো সম্প্রসারণ হয়েছে জেলায়। চাষীরা যখন কোনো নতুন প্রযুক্তি পান তখন পুরনো প্রযুক্তি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন এটাই বাস্তবতা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোখলেসুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, আমের নতুন নতুন জাত পুরনো জাতের জায়গা দখল করে নিচ্ছে। তবে বড় বাগান কেটে ফেলে নতুন জাত সম্প্রসারণ করা ঠিক হবে না।

প্রতিনিধি/একেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর