শনিবার, ৪ মে, ২০২৪, ঢাকা

‘রাজশাহী কলেজ শহীদ মিনারই ভাষা শহীদদের প্রথম শ্রদ্ধার প্রতীক’

জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:৫১ পিএম

শেয়ার করুন:

রাজশাহী কলেজের শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ বা স্মৃতি মিনার যাই বলি না কেন এটিই ছিল শহীদদের প্রতি প্রথম শ্রদ্ধার প্রতীক বলে মন্তব্য করেছেন রাজশাহীর ভাষাসৈনিক মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জী। 

ঢাকা মেইলকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেন এ ভাষাসৈনিক।


বিজ্ঞাপন


তিনি দাবি করেন, ঢাকার পরবর্তীতে বাংলা ভাষার আন্দোলন রাজশাহীতেই প্রবলতর ছিল। তাই অবিলম্বে রাজশাহী কলেজের স্মৃতি স্তম্ভকে দেশের প্রথম স্মৃতি স্তম্ভ হিসেবে ঘোষণা করা হোক। 

প্রবীণ এ ভাষাসৈনিক রাজশাহী নগরীর বাসিন্দা। ১৯৫২ সালে নগরীর লোকনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। ছোট বেলা থেকেই রাজনীতি সচেতন হওয়ায় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গেও সখ্যতা ছিল তার, ছিল নিয়মিত যোগাযোগও। সেই থেকেই যোগ দেন '৫২র ভাষা আন্দোলনে। কেবল ভাষা আন্দোলনই নয়, বাঙালির পক্ষের সব আন্দোলন সংগ্রামে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন তিনি। 

আন্দোলন-সংগ্রামে মুখরিত ৫২’র উত্তাল দিনগুলোর কথা স্মৃতিচারণ করে আখুঞ্জি বলেন, ২১ শে ফেব্রুয়ারি সংগ্রামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন ছিল। তৎকালীন পার্লামেন্ট অধিবেশন চলছিল, আমার একটা মিছিল হওয়ার কথা ছিল। তারা মিছিল করে পার্লামেন্টে গিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার জন্য তারা স্লোগান ও তাদেরকে অবগত করার কথা ছিল, দেশের মানুষ বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে দেখতে চায়। 

অশীতিপর ভাষাসৈনিক বলেন, আমরা রাজশাহীর ভাষা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীরা খুব সজাগ ছিলাম যে এই দিনে কিছু একটা ঘটনা ঘটবে। সে সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব ভালো ছিল না। তখন মোবাইল ছিল না, ট্রেনও একটি মাত্র ছিল যেটা সন্ধ্যার সময় ঢাকা থেকে রাজশাহী আসতো। যার ফলে ওই দিন আমরা উদ্বিগ্নভাবে অপেক্ষায় ছিলাম। স্টেশনে আমাদের লোক ঢাকা থেকে আসা এক কর্মীর কাছে খবর পেল, ঢাকায় রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনের মিছিলের উপর গুলি হয়েছে, অনেক নিহত ও আহত হয়েছে। 


বিজ্ঞাপন


তিনি আরও বলেন, খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা রাজশাহী শহরের সমস্ত মেস এবং ছাত্ররা যে যেভাবে পারছেন সে সেখানে খবর দেই, রাজশাহী কলেজে হোস্টেলের ভেতরের মাঠে একটা আলোচনা সভা হবে। সেই আলোচনা সভায় ঢাকায় গুলি চালানোর নিন্দা জানানো হবে এবং পরবর্তী সংগ্রামের আরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সেই আলোচনায় ড. গোলাম আরিফ টিপু, ড. এস এম আব্দুল গাফফার, নাট্যকার মনতাজ উদ্দিন, অ্যাডভোকেট মহসিন প্রামাণিকসহ নেতৃবৃন্দ ছিলেন। 

সে সময় কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষার্থীরা রাজশাহী কলেজে ভর্তি হতেন। রাজশাহী কলেজই দ্বিতীয় প্রেসিডেন্সি হিসেবে পরিগণিত হতো। এখান থেকেই ছাত্র রাজনীতির নেতৃত্ব বেরিয়ে আসতো। রাজশাহীর সমস্ত আন্দোলন ছিল রাজশাহী কলেজ কেন্দ্রিক। তাই রাজশাহী কলেজেই সবাইকে নিয়ে বসা হলো।

ভাষাসৈনিক বলেন, সভায় নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন এবং মুসলিম লীগ সরকারের বর্বোচিত গুলি চালানোকে অত্যন্ত পৈশাচিক ও নিন্দনীয় বলে আখ্যায়িত করেন। সেই সাথে শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য একটা শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। 

সিদ্ধান্ত মোতাবেক গোলাম আরিফ টিপু, এস এম আব্দুল গাফফার, মনতাজ উদ্দিন, অ্যাডভোকেট মহসিন প্রামানিক, অ্যাডভোকেট আব্দুর রাজ্জাক, ইঞ্জিনিয়ার নাজমুল, মহির উদ্দিনের সাথে আমিসহ আরও অনেকে আশেপাশের ইট-পাটকেলের টুকরা জোগাড় করে কাঁদার গাঁথুনি দিয়ে রাত্রি ১২টা/১টা পর্যন্ত একটা শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ গড়ে তুলি। সেই শহীদ স্মৃতি স্তম্ভে ‘উদয়ের পথে শোন কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই, নি:শেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’ লিখা ছিল বলেও উল্লেখ করেন তিনি। 

তারপর সারারাত স্মৃতি স্তম্ভটি পাহারা দিয়ে রাখি। সকালে আমরা যখন বাড়ি ফিরে যাই, শুনতে পাই মুসলিম লীগের গুণ্ডা এবং পুলিশ বাহিনী সেই শহীদ স্মৃতি স্তম্ভটি গুড়িয়ে দিয়েছে। তারা গুড়িয়ে দেওয়ার পরেও আমাদের কিছু করার ছিল না। কেননা তারা ছিল শক্তিধর। বিভিন্ন জায়গায় মিটিং করে আন্দোলনকে রাজশাহীতে আরও জোরদার করার চেষ্টা করা হয়। শেষ পর্যন্ত আমরা জয়ী হই। মায়ের ভাষা বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষার রূপ দান করতে সক্ষম হই বলে জানান ভাষাসৈনিক। 

বাঙালি একটা আলাদা সংস্কৃতির অধিকারী উল্লেখ করে আখুঞ্জি বলেন, বাংলা ভাষার আন্দোলন আপাত দৃষ্টিতে একে রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন বলেই আমরা দেখতে পাই। কিন্তু এর মধ্যে নিহিত ছিল, বাঙালি একটি আলাদা জাতিসত্তা। বাংলা ভাষার ভিত্তিতে এই জাতিসত্তা ও সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এখান থেকেই বাঙালি জাতি একটা আলাদা সংস্কৃতির অধিকারী, এই আত্মসম্মানবোধ বাংলা ভাষা আন্দোলন থেকেই এর সূচনা। যা বহুমুখী প্রভাব বিস্তার করে। 

সমস্ত আন্দোলনের সূতিকাগৃহ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন জানিয়ে অশীতিপর ভাষাসৈনিক বলেন, বাঙালিরা চায় অত্যন্ত সংগত কারণেই যে তৎকালীন পাকিস্তানে বাঙালিরাই ছিল সংখ্যাগুরু। সেই সংখ্যাগুরুদের মাতৃভাষাকে তুচ্ছ করে সরিয়ে দিয়ে সেখানে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র ছিল অত্যন্ত অন্যায়। কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যিনি দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ করলেন, তিনি নিজে মুখেও ঢাকায় এসে ঘোষণা করলেন, ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে একমাত্র পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা।’ এই কথা ঢাকার মেধাবী ছাত্ররা গ্রহণ করতে পারেন নাই, সঙ্গে সঙ্গে তারা তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন, ‘No, No, No.' সেখান থেকেই স্বাধীকার আন্দোলন, স্বাধীনতার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ সবকিছুরই সূতিকাগৃহ হলো রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। 

যে তারুণ্যে ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, সেই তারুণ্য নিয়ে একরাশ হতাশা এই ভাষা সৈনিকের। তিনি বলেন, দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, দুই’শ বছরের উপনিবেশিক শাসনের যে প্রভাব আমাদের মাঝে রেখে গেছে সেই প্রভাবের কারণে আমরা এখনও সেই ইংরেজির মায়া কাটাইয়ে উঠতে পারি নাই। আমাদের অনেকে সেই ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত রাষ্ট্রভাষাকে অসম্মান করে ইংরেজিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি। কথায় কথায় বাংলা ভাষার মধ্যে ইংরেজি ব্যবহার করে থাকি। 

ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ভাষা সংগ্রামী বলেন, যত্রটত্র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয় অথচ অলি-গলিতে একটা ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে ইংরেজি শিক্ষার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতেছে। আরেকটা কারণ হলো: চাকরি-বাকরি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইংরেজির একটা গুরুত্ব আছে। তারা অবশ্যই ইংরেজি ভালো শিখবে, তবে তার সঙ্গে মাতৃভাষা বাংলাও শিখতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এই ভাষাকে কোনোভাবেই অবহেলা করার সুযোগ নেই। 

বাংলাকে ৭০/৭২ বছরের মধ্যেও সেই পর্যায়ে সেই প্রমিত ভাষা হিসেবে তুলে ধরতে পারি নাই। এটা আমাদের ব্যর্থতা। এ কারণে মানুষ ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ইংরেজি শেখানোর চেষ্টা করছে। বাংলাকে ২য়/৩য় পর্যায়ে স্থান দিয়ে ইংরেজিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। অনেক বেতন দিয়ে পড়ানো হচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক বলেও মনে করেন তিনি। 

সাইনবোর্ডে বাংলার প্রচলন নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে এই ভাষা সংগ্রামী বলেন, রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার পরপর বিভিন্ন সাইনবোর্ডে কে কত ভালো নাম বাংলায় রাখতে পারে, কে কত প্রতিষ্ঠানের নাম বাংলায় রাখতে পারে এর একটি প্রতিযোগিতা চলছিল। কিন্তু সেটা যেন স্তিমিত হয়ে আসছে। আমাদের দাবি, ইংরেজি থাকুক কিন্তু তার পাশে অথবা বাংলা ভাষার পাশে ইংরেজি থাকুক আপত্তি নেই। এটি বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার দাবিও জানান তিনি।

প্রতিনিধি/ এজে

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর