বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

ঝিনাইদহের ফাতেমা একাই একশ 

জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১১:৪০ পিএম

শেয়ার করুন:

ঝিনাইদহের ফাতেমা একাই একশ 

লক্ষীপুর সড়ক ধরে সাবদালপুর বাজারে যাবার পথে দেখা মেলে এক মধ্যবয়সী নারীর। দূর থেকে দেখা যায় বাজারে ঢোকার খোলা রেলগেটটি পরিস্কার করছেন। কিছুক্ষণ পরেই সবুজ পতাকা হাতে গেটের দুই পাশের মানুষকে সতর্ক করছেন ট্রেন আসছে গেট পার হওয়া যাবে না। মুহুর্তেই ট্রেন আসে, গেটটি অতিক্রম করলে তিনি আবারো সংকেত দেন নিরাপদে গেট (রেললাইন) পার হতে পরবেন। এভাবেই সকাল ৬টা থেকে সন্ধা ৬টা পর্যন্ত নির্দিষ্ট সময়ে যাত্রিবাহি ও মালবাহি ১৩টি ট্রেন আসাযাওয়ার সময় গেটটি নিরাপদ রাখার দায়িত্ব পালন করছেন মোছা. ফাতেমা খাতুন সুমি। প্রতি মুহুর্তে ছোট-বড় যানবাহন ট্রেনলাইন পার হয়। এরপরও এই গেটে নেই কোন ব্যারিকেড বা রাস্তায় বিট কিছুই নেই। রোদ-বৃষ্টি-ঝড় মাথায় নিয়ে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করছেন দিনের পর দিন। তাঁর যোগদানের পর থেকে আজ পর্যন্ত ওই রেলগেটে কোনো ধরনের দুর্ঘটনাও ঘটেনি।

মোছাঃ ফাতেমা খাতুন সুমি ঝিনাইদহ জেলার কোটচাঁদপুর উপজেলার সাবদালপুর গ্রামের ইদ্রিস আলীর মেয়ে ও মনিরুল ইসলামের স্ত্রী। তার স্বামী একজন ইলেকট্রনিক মিস্ত্রী। তিনি অষ্টম শ্রেণীর সনদে ২০১৩ সালে চাকুরির জন্য আবেদন করেন। ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল বাংলাদেশ রেলওয়ে-তে গেটম্যান হিসেবে যোগদান করেন। প্রথমে তিনি কোটচাঁদপুর রেলষ্টেশনে যোগদান করলেও বর্তমানে সাবদালপুর ষ্টেশনে ডেপুটেশনে আছেন।


বিজ্ঞাপন


সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সাবদালপুর রেলষ্টেশনের পাশেই লক্ষীপুর-সাবদারপুর সড়কের উপর রেলগেটটি। ব্যস্ততম ওই সড়ক দিয়ে সাধারণ পথচারী, স্কুল কলেজ-গামী শিক্ষার্থীসহ যাতায়াত করছে ছোটবড় সবধরনের যানবাহন। ট্রেন আসার সিগনাল পাওয়ার সাথে সাথে পথচারীদের সতর্ক করে সবুজ পতাকার মাধ্যমে ট্রেনকে সংকেত দিচ্ছেন লাইন ক্লিয়ার আছে। সংকেত দেখে পথচারীরাও দুইদিকে ট্রেনটি অতিক্রম করা পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন। রেলগেটটি স্টেশনের তালিকাভুক্ত নয়, যে কারণে সেখানে নেই কোনো প্রতিবন্ধক ও গেটম্যানের দাঁড়ানোর ঘর। রোদ, বৃষ্টি ও ঝড়ে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থেকে তিন বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছেন এই নারী গেটম্যান।

সাবদালপুর গ্রামের রোকেয়া খাতুন জানান, গত তিন বছর ধরেই দেখছেন সুমি এই গেটম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। দাড়িয়ে থেকেই পথচারীকে থামিয়ে ট্রেন পারাপার করেন। একজন মেয়ে হয়েও যদি এই কঠিন দায়িত্ব পালন করতে পারে তাহলে অন্য মেয়েরা কেন পারবে না। সুমিকে দেখে অন্য মেয়েরাও অনুপ্রাণিত হবে ।

একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী মোছা. আসমা খাতুন জানান, প্রতিদিন ভোর সকালে পড়াশোনা করতে যাতায়াত করতে হয় খোলা গেট দিয়ে। তখন দেখতে পান ট্রেন আসার সময় তিনি পতাকা হাতে ট্রেনগুলো গেট পার করেন। তাকে দেখে অনেকটা গর্বহয় তার। তিনিও চান সুমির মত একজন কর্মঠ কর্মজীবি নারী হতে।

সাবদালপুর বাজারের ব্যবসায়ী শরিফুল ইসলাম জানান, রেলগেট দিয়ে সারদিনে অনেক লোকজন যাতায়াত করে। সাধারণ মানুষের যানমালের নিরাপত্তার জন্য মহিলা গেটম্যান নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু তার নিজেরই কোন নিরাপত্তা নাই। সরকারের কাছে আবেদন এই মহিলা গেটম্যানের জন্য এখানে একটি গেটবক্স করে দেয়।


বিজ্ঞাপন


কলেজ শিক্ষার্থী রবিউল ইসলাম জানান, এলাকার যে মেয়েটি রেল-গেটের দায়িত্ব পালন করেন তিনি একদমই ব্যতিক্রম। অনেক জায়গাই দেখেছেন কোথাও রেলগেটে মহিলা গেটম্যান নাই।

গেটকিপার ট্রাফিক ফাতেমা খাতুন সুমি  বলেন, ৩০ এপ্রিল ২০১৯ সালে গেটকিপার ট্রাফিক পদে বাংলাদেশ রেলওয়েতে যোগদান করেন। সাবদালপুর ষ্টেশনের পাশেই টি-৬০ গেটের দায়িত্ব পালন করেন। অনেক গুলো চাকরির আবেদন করেছিলেন কোথাও চাকরি হয়নি। আবার বয়স সিমা শেষ হয়ে আসছিল। এই আবেদনটিই ছিল শেষ যার কারনে মহিলা হয়েও এই গেটকিপারের চাকরি নেন। কর্মযেহেতু এটা যার কারনে তিনি সবকিছু মেনে নিয়েছেন।

তিনি বলেন, আমি মানুষের সেবা দিয়ে যচ্ছি। অনান্য গেটম্যানের ত্রুটির কারনে দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু তিনি এই গেটে দায়িত্ব নেওয়ার পরে কখনো কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি। ট্রেন আসার ১০ মিনিট আগে সিগন্যাল পেয়ে গেটে আসেন এবং রাস্তায় চলাচলের মানুষকে বা গেটের আশপাশের মানুষকে নির্দেশ দেন, তারা দুই পাশে দাড়িয়ে যাই তখন ট্রেনের সিগনাল দিলে ট্রেন পার হয়ে যায়। তিনি মানুষের যানমালের নিরাপত্তা দিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু নিজের কোন নিরাপত্তা নেই। এখানে যদি একটা বসার জায়গা থাকতো তাহলে হয়তো ভালো হতো। আবার বছরে একটি ছুটিও হয়না তার। ঈদের দিনও দায়িত্ব পালন করতে হয়।

তিনি আরো বলেন, মহিলা হিসেবে ঝুকি বলতে, সাবদালপুর-আন্দুলবাড়িয়া সড়কের সাবদালপুর পুলিশ ফাঁড়ির সামনে একটি গেট রয়েছে। সেখানে দুইজন গেটম্যান পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন। ওই গেটে বসার জন্য ঘর ও যানবাহনের গতি রোধে ব্যারিকেড রয়েছে। তাঁর দায়িত্বে থাকা গেটটি বেশি ব্যস্ততম সড়কে অবস্থিত। প্রতি মুহূর্তে ছোট-বড় যানবাহন ট্রেনলাইন পার হয়। এরপরও এই গেটে কিছুই নেই। তিনি খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করেন। ব্যারিকেড না থাকায় সারাক্ষণ ঝুঁকিতে থাকতে হয়।

jhh

সাবদারপুর ষ্টেশনের সহকারি স্টেশন মাস্টার মো. গোলাম রসুল বলেন, ষ্টেশনের পাশেই টি-৬০ নামে উন্মক্ত গেটের দায়িত্ব পালন করেন ফাতেমা খাতুন সুমি। যেহেতু গেটটি উন্মুক্ত সেই ক্ষেত্রে তার দায়িত্ব পালনে রোদ বৃষ্টি ঝড়ে তাকে অনেক বেগ পেতে হয়। তার কর্তব্য পালন কালে আন্তনগর, লোকালসহ অনেকগুলো ট্রেন ডিসবার্স হয়। সুমি যে ঝুকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করে আসছে সেটি আমাদের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ জানে এবং খুব দ্রুতই ওই গেটের একটি সমাধান হবে বলে আশা করছি।

প্রতিনিধি/একেবি

 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর