শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

দুই টাকায় বই ভাড়া দেন ‘বইদাদু’

রেজাউল করিম জীবন
প্রকাশিত: ৩১ জানুয়ারি ২০২৩, ০৫:৩১ পিএম

শেয়ার করুন:

দুই টাকায় বই ভাড়া দেন ‘বইদাদু’
ছবি : ঢাকা মেইল

করতেন ব্যবসা। পরে এ পেশা ছেড়ে ফিরে আসেন বইয়ের জগতে। নিজে তো বই পড়েনই, অন্যদেরও পাঠের অভ্যাস গড়ে তুলতে অনুপ্রাণিত করে চলেছেন নিরন্তর। সত্তর পেরোনো ওমর শরীফকে রংপুর ও আশেপাশের পরিচিত ব্যক্তিরা ডাকেন ‘বইদাদু’ বলে। 

বই পড়ার অদম্য ইচ্ছা থেকে পুরোনো বই সংগ্রহের নেশা পেয়ে বসে তাকে। নানা উপায়ে বই সংগ্রহ করে তিনি বিশাল এক ভান্ডার গড়ে তুলেছেন। সেই ভান্ডার থেকে তিনি মানুষকে বইভাড়া দেন। পড়া শেষে পাঠক তাকে বইটি ফিরিয়ে দিয়ে যান। এরপর সেই বই ঘুরতে থাকে এক পাঠক থেকে আরেক পাঠকের হাতে।


বিজ্ঞাপন


ছেলেবেলায় টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে বই কিনে পড়েছেন। সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। বন্ধ হয়ে যায় পড়ালেখা। এরপর স্কুলের আঙিনা মাড়াননি। জীবিকার তাগিদে ব্যবসায় নেমেছেন, চাকরি করেছেন। কিন্তু কিছুতেই থিতু হতে পারেননি।

রংপুর নগরীর শহীদ জররেজ মার্কেটের একটি দোকানে বসেন ওমর শরীফ। সেখানে ভাগেজোকে বসেন। দোকানজুড়ে বইয়ের স্তূপ। বেশির ভাগ বই বাংলা সাহিত্যের প্রধান লেখকদের। রয়েছে বিদেশি লেখকদের বইও। গল্পসমগ্র, উপন্যাস, কবিতা ও আত্মজীবনীমূলক বইও রয়েছে তার সংগ্রহে। বাংলা সাহিত্যের প্রধান লেখকদের অধিকাংশ বই, এমনকি উইলিয়াম শেকসপিয়ার, ম্যাক্সিম গোর্কি, টলস্টয়ের বইও রয়েছে। এসব বইয়ের অধিকাংশ ওমর শরীফের পড়া।

দোকানের ভেতরে এককোণে বইয়ের মধ্যে তিনি বসে থাকেন। মাত্র দুই টাকা ভাড়ার বিনিময়ে বই পাঠে উদ্বুদ্ধ করেন পাঠকদের। তবে বইয়ের ভাড়া প্রকারভেদে ১০ থেকে ৫০ টাকা করা হয়েছে এখন। কিশোর, তরুণ থেকে শুরু করে সব বয়সের পাঠকই তাঁর কাছ থেকে বই নিয়ে পড়েন। 

তথ্যপ্রযুক্তির প্রবাহে পাঠকের হাতের মুঠোয় বই পৌঁছালেও, বইদাদুর বই ভাড়ায় তেমন ভাটা পরেনি। বরং সময়ের সঙ্গে বাড়ছে নিত্যনতুন বইয়ের চাহিদা। 


বিজ্ঞাপন


rangpur

বইদাদু ওমর শরীফ শৈশব থেকেই ছিলেন বইয়ের পোকা। হাতে টাকা পেলেই বই কিনতেন তিনি। এভাবেই ধীরে ধীরে বইয়ের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে তাঁর। কর্মজীবনের শুরুতে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করলেও পরে কাজ নেন পণ্য উৎপাদনকারী একটি প্রতিষ্ঠানে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে চলতে থাকে বই সংগ্রহের কাজ। বই সংগ্রহের পেছনে ছুটতে গিয়ে হাতছাড়া হয়ে যায় চাকরি। চাকরি হাতছাড়া হলেও দমে যাননি। বরং নতুন উদ্যোমে বইপড়ার আগ্রহটা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পুরাতন বই সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। 

২০০১ সাল থেকে ওমর শরীফ জোরেসোরে শুরু করেন বই সংগ্রহের কাজ। বিভিন্ন বইয়ের দোকানের সামনে ঘুরতেন। কোথাও বইয়ের সন্ধান পেলে ছুটে যেতেন তাদের বাড়িতে। কম দামে বই কিনে আনতেন। আবার পুরোনো কাগজ-বিক্রেতা বা ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকেও বই কিনতেন। এভাবে সংগ্রহ করতে করতে বইয়ের এই বিশাল ভান্ডার গড়ে তোলেন তিনি। 

একসময়ে তার ঠাঁই হয় শহিদ জররেজ মার্কেটে। বই সংগ্রহ করতে গিয়ে পরিচয় হয় পুরাতন বই ব্যবসায়ী রুহুল আমিনের। চেনাজানা ও বইয়ের প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ থেকেই রুহুল আমিন তাকে নিজের দোকানের একটি অংশ ছেড়ে দেন বিনামূল্যে। আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় পাঠকের সঙ্গে তার বই লেনদেনের সম্পর্ক। শুরুতে মাত্র দুই টাকার বিনিময়ে শিক্ষার্থীসহ নানা পেশার পাঠককে বই ভাড়া দেওয়া শুরু করেন তিনি। এখন অবশ্য বইয়ের প্রকারভেদে তা বেড়ে ১০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে। পাঠকদের আগ্রহ বাড়াতে কখনও বিনিময় ছাড়াও বই দেন তিনি। আবার কারো যদি বই পড়ে ভালো লাগে, তাহলে বিনামূল্যেও তাকে বই পড়তে আরও বই দেন। ভাড়া নেওয়া বই অনেক সময় কেউ কেউ ফেরত দেয় না। 

তবে অধিকাংশ পাঠকই ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে বই ফেরত দিয়ে নতুন করে বই নিয়ে যান বলে জানান তিনি। খাতা-কলমে সঠিক হিসেব না থাকলেও বর্তমানে তার বই ভাড়া নেওয়ার পাঠকের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। যদিও সবাই এখন সক্রিয় না। 

rangpur

ওমর শরীফ ব্যক্তি জীবনে স্ত্রী ও দুই ছেলে সন্তান নিয়ে বর্তমানে মুলাটোল এলাকাতে বসবাস করছেন। বই ভাড়া আর বিক্রি থেকে সামান্য যে আয় হয় তাতেই কোনোরকমে সংসার চলছে তার। তবে প্রচারবিমুখ ওমর শরীফ বই পড়তে এবং বইপড়াতেই বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করেন।  

বইদাদুর দোকানে গেলেই দেখা মিলবে বইপ্রেমিদের। কেউ আসেন বই নিতে, আবার কেউ আসেন বই জমা দিতে। যারা নিয়মিত বই নিয়ে থাকেন, তারা সবাই সময়ের আগেই জমা দিয়ে নতুন বই নিয়ে থাকেন। এমন কয়েকজন পাঠকের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। 

ছড়াকার বেলায়েত হোসেনও একই কথা জানান। তিনি বেশিরভাগ ছড়া সম্বলিত বই ভাড়া নিয়ে থাকেন। পড়া হলেও ফিরত আবারো বই নেন তিনি। 

রংপুর টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ফাহানা বিথি বলেন, পুরাতন বই কিনতে এসে বইদাদুর কথা জানতে পেরেছি। প্রায় তিন বছর ধরে ভাড়ায় পড়েন তিনি। তাছাড়া বইভাড়া দেওয়ার বিষয়টা বেশ ভালো লেগেছে তার। অল্প টাকায় বই নিয়ে পড়া যায়। 

একই প্রতিষ্ঠানে আসিফুল ইসলাম জানান, তিনিও ভাড়ায় বই নিয়ে পড়ে থাকেন। এভাবে রংপুর টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মতো সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রংপুর সরকারি কলেজ, জিলা স্কুলসহ বেশ কিছু স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী নিয়মিত বই ভাড়ায় নেন। 

নাহিদা ইয়াসমিন পেশা সমাজসেবা কর্মকর্তা। চাকরি জীবনে ব্যস্ত থাকলেও অবসরে লেখালেখি করেন তিনি। লেখালেখিতে যে কোনো বইয়ের প্রয়োজনে বই দাদুর সহযোগিতা নিয়ে থাকেন তিনি। কেননা বইদাদুর সংগ্রহে অনেক বেশি দুষ্প্রাপ্য বই রয়েছে, যা অন্য কোথাও সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না।  

এদিকে বইদাদু ওমর শরীফ যার আন্তরিক সহযোগিতায় শহিদ জররেজ মার্কেটে ঠাঁই হয়েছে, সেই কম দামি বইমেলা দোকানের মালিক রুহুল আমীন মারা গেছেন প্রায় দুই বছর আগে। এখন তার ছেলেরা বইয়ের ব্যবসা করছেন। কথা হয় মেঝো ছেলে তপুর সঙ্গে। 

তপু জানান, ওমর দাদুর বই পড়ার আগ্রহ দেখে বাবা দোকানের একটি অংশ বিনামূল্যে দিয়েছেন। সেখানে দাদু নিজে বই পড়েন এবং ভাড়াও দেন। প্রতিদিনই সেখানে পাঠক আসে। পাঠকদের বই পড়তে উৎসাহিত করেন। এভাবেই দাদু অল্প টাকার বিনিময়ে বই পড়াতে আগ্রহী করে তোলেন পাঠককে। 

ওমর শরীফ আক্ষেপ করে বলেন, বয়স বাড়ছে, নানা অসুখ পেয়ে বসছে। তাছাড়া দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে এখন আর পর্যাপ্ত বই সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। সরকারি-বেসরকারিভাবে কিছু বই সংগ্রহে সহযোগিতা করলে উপকার হতো। এখন পর্যন্ত কেউ সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন নি। 

প্রতিনিধি/এইচই

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর