সাতক্ষীরায় ২০ টাকায় পাওয়া যাবে নতুন মোটরসাইকেল। এ জন্য ২০ টাকা দিয়ে কাটতে হবে লটারির টিকিট। প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলা সদরের বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুস সামাদ স্মৃতি সংঘের মাঠে বিজয় মেলা উপলক্ষে রমরমিয়ে চলছে ‘ওঠাও বাচ্চা’ লটারির আসর। অভিযোগ, সাংবাদিক, প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও কতিপয় জনপ্রতিনিধিকে ম্যানেজ করেই মেলার মূল ফটকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি লাগিয়ে নামমাত্র পুরস্কার দিয়ে প্রতিদিন লুটপাট করা হচ্ছে ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকা।
রোববার (১৫ জানুয়ারি) সকাল ৮ টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত কালিগঞ্জ, দেবহাটা ও শ্যামনগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কালিগঞ্জ সামাদ স্মৃতি সংঘের মাঠ, বাসটার্মিনাল, ফুলতলা, কলেজ মোড়, মৌতলা বাজার, নলতা চৌরাস্তার মোড়, পিরোজপুর মোড়, কুশুলিয়া হাটের মোড়, কালিবাড়ি বাজার, উজিরপুর বাজার, তারালী বাজার, শ্যামনগর বাসস্ট্যান্ড, বংশীপুর মোড়, দেবহাটার হাদিপুর, সখীপুর, পারুলিয়া বাসস্ট্যান্ড, আশাশুনি ধান্যহাটিসহ বিভিন্ন স্থানে কালিগঞ্জের বিজয় দিবস- ২০২২ উপলক্ষ্যে চটকদারি পুরস্কারের ঘোষণা দিয়ে চলছে লটারিরর মাইকিং। লটারির প্রতিদিনের টিকিট মূল্য ২০ টাকা। যদিও প্রচার ইজিবাইকের পিছনে লেখা আছে প্রবেশের টিকিটের উপর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান।
বিজ্ঞাপন
রোববারের আকর্ষণ হিসেবে ৬১টি পুরস্কারের মধ্যে প্রথম পুরস্কার সুজুকী গ্লাক্সীর ১৫৫সিসি মটর সাইকেল, ৩১তম ও শেষ পুরস্কার হিসেবে একটি করে ৮০ সিসি রানার মটর সাইকেল একজোড়া করে দুজনের সোনার কানের দুল ও ১০টি মোবাইল সেট পুরস্কার হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। শহীদ আব্দুস সামাদ স্মৃতি সংঘের মাঠে অনুষ্ঠিত বিজয় মেলার প্রধান ফটকের বাম দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী ডা. আ.ফ.ম রুহুল হকের ছবি রয়েছে। ডান দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কালিগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এনামুল হোসেন ছোটনের ছবি শোভা পাচ্ছে। মেলা শুরুর প্রথম আট দিনে একটি লটারির টিকিটের মূল্য ১০টাকা ও তারপর থেকে লটারির টিকিটের মূল্য ২০টাকা ধার্য করা হয়েছে।
রোববার টিকিট ফেলার জন্য ৭৬টি বক্স ও প্রচারণার জন্য ২৮টি ইজিবাইকের এর ব্যবস্থা করেছেন ‘ওঠাও বাচ্চা’ লটারির পরিচালক মানিক শিকদার। কালিগঞ্জ উপজেলার মধ্যে প্রচারণার জন্য একজন ইজিবাইক চালককে দেওয়া হচ্ছে এক হাজার টাকা।
উপজেলার বাইরে গেলে দেড় হাজার। এক একজন প্রচারকারি পাচ্ছেন ৭০০ থেকে এক হাজার টাকা। যারা বিভিন্ন স্থানে বসে টিকিট বিক্রি করছেন তারা প্রতিদিন পাচ্ছেন পাঁশত থেকে সাতশত টাকা। রাত ১০টার পরপরই লটারির শুরুতেই দর্শণার্থী এক বাচ্চাকে মঞ্চে ডেকে নিয়ে তার চোখে কালো কাপড় বেঁধে চারকোনায় চারজনকে দাঁড় করিয়ে কাপড় টানিয়ে ঢালা হয় বিক্রিত টিকিটের মুড়ি বা ছোট অংশ।
এরপর ওই বাচ্চা একএক করে নির্ধারিত পুরস্কারের আলোকে সেই কয়টি লটারিরর টিকিটের মুড়ি অংশ তুলে ধরে সকলের সামনে। লটারিরর নাম্বার মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়।
বিজ্ঞাপন
কালিগঞ্জের বাজারগ্রাম রহিমপুরের ওমর ফারুখ, তেঁতুলিয়া গ্রামের সাজ্জাত আলী ও নলতা আহছানিয়া মিশন এলাকার রফিকুল ইসলাম জানান, গত ৩০ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাতটায় কালিগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাষ্টার নরীম আলী মুন্সির সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক এনামুল হোসেন ছোট এর সঞ্চলনায় এক মাস সাত দিনব্যাপি বিজয় মেলার উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী ডাঃ আ.ফ.ম রুহুল হক।
জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদনের প্রেক্ষিতে গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর এক মাস সাত দিনের এ মেলার চালানোর অনুমতি দেন সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের নেজারত শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট (এনডিসি) বাপ্পি দত্ত রণি। ৩০ ডিসেম্বর থেকে অনুমোদন পাওয়া মেলায় যাত্রাপালায় নগ্ন নৃত্য, লটারির, জুয়া ও হাউজি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ কালিগঞ্জসহ সাতক্ষীরার ক্ষমতাসীন দল ও তার অঙ্গ সংগঠণের নেতা, কয়েকজন বড় মাপের জনপ্রতিনিধি কালিগঞ্জের তিনটি সাংবাদিক প্রতিষ্ঠান, সাতক্ষীরার চারটি সাংবাদিক প্রতিষ্ঠান, ছোট-বড় খুচরা অন লাইন সাংবাদিক ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই প্রতিদিন এ রক্তচোষা জুয়া চলছে। গত এক সপ্তাহের পুরস্কারের হিসাব করে তারা বলেন, প্রতিদিন গড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকার পুরস্কার দেওয়া হয়। অথচ প্রতিদিন ২২ থেকে ২৫ লাখ টাকার টিকিট বিক্রি হয়।
সেক্ষেত্রে এক মাস সাত দিন মেলা চললে প্রথম ৮ দিনের ১০ টাকা টিকিট ও পরবর্তী একমাসের বিক্রিত টিকিট মূল্য থেকে পুরস্কার মূল্য, ইজিবাইক, প্রচারকারি, ডেকরেটরসহ আনুষঙ্গিক খরচ বাদ দিয়ে মোট ৬০ কোটি টাকার বাণিজ্য হবে আয়োজক কমিটির। তারা আরো জানান,লটারির টিকিট কেটে পুরস্কারের নামে বাড়ছে চুরি ও ছিনতাই। বাড়ি থেকে জিনিসপত্র ও টাকা চুরি করে লটারির টিকিট কিনতে বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের টাকা দিয়ে প্রতিদিন মোটা অংকের লটারির টিকিট কিনতে যেয়ে অনেকেই হচ্ছেন সর্বশান্ত। আবার ঘটছে পারিবারিক অশান্তি। অবিলম্বে এ লটারির বন্ধের দাবি জানান তারা।
কালিগঞ্জ উপজেলার মুকুন্দ মধুসুধনপুরের ইসমাইল হোসেন পেশায় ভ্যানচালক। ভ্যান চালিয়ে প্রতিদিন যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে মেলা উদ্বোধনের পরদিন থেকে ২০ থেকে ২৫ টি করে টিকিট কিনেছেন। শনিবার পর্যন্ত ১৫ দিনে একটি পুরস্কার পাননি। অথচ বাড়িতে চাল ও বাজার কম করার প্রতিবাদ করতে যেয়ে স্ত্রী রমেছা খাতুনকে টিপিয়ে কোমরের হাড় খেঙে দেওয়া হয়েছে। তাকে সাতক্ষীরার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে গত বুধবার।
সাদপুরের রুবেল হোসেন। পেশায় বাসের হেলপার। প্রতিদিন যে আয় হয় তাতে ১০টির বেশি টিকিট কেনা যায় না। বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েও বেশি টিকিট কিনেছেন। এখন আর কেউ টাকা ধার না দেওয়ায় বাড়ির লোহার শাবল চুরি করে শুক্রবার রাতে ৯০ টাকায় বিক্রি করে অতিরিক্ত চারটি টিকিট কিনেও পুরস্কারের ভাগ্য খোলেনি রুবেলের।
কাঁকশিয়ালী গ্রামের ইমান আলীর ছেলে নজরুল ইসলাম নজু পুরস্কারের লোভে প্রতিদিন ১০০ থেকে দেড়শত টিকিটি কিনেছেন। বিক্রি করেছেন একটি গাভী ও কয়েকটি হাঁস মুরগি। গত ১৫ দিনে লটারিরর পিছনে খরচ করেছেন ৭০ হাজার টাকা। প্রতিবাদ করে লাভ না হওয়ায় শনিবার সকালে স্ত্রী বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন।
একইভাবে কালিগঞ্জ বাস টার্মিনালের সৈনিক হোটেলের মালিক অবসরপ্রাপ্ত বিডিআর সদস্য মিলন হোসেনের ছেলে সেলু প্রতিদিন বড় অংকের টিকিট কেটেছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বন্ধুদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে। এখন চলছে প্রতিনিয়ত অশান্তি। একইভাবে কালিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মোড়ে আজগার আলীর ছেলে চায়ের দোকানদার সিরাজুল ইসলাম সিরাজ স্ত্রী ও ছেলেকে দোকানে বসিয়ে ছুটেছেন লটারিরতে মোটর সাইকেল পাওয়ার আশায়। প্রতিদিন কিনেছেন ৭০ থেকে ১০০টি লটারির। এখন তার হাঁড়ি না জ্বলার উপক্রম। উড়ে গেছে সংসারের শান্তি নামের সাদা পায়রাটি।
লটারির কিনে পুরস্কারের লোভে পূর্ব নলতার আজগার আলী, কুশুলিয়ার রাজিব, শ্যামনগরের বাধঘাটার রুহুল আমিন, সখীপুরের আবুল বাসারসহ অনেকে এ পর্যন্ত ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার টিকিট কিনেও তাদের কপাল বড় হয়নি।
এ ব্যাপারে কালিগঞ্জ শহীদ আব্দুস সামাদ স্মৃতি সংঘের মাঠে বিজয় মেলা উপলক্ষে লটারিরর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মানিক শিকদার রবিবার দুপুরে এ প্রতিবেদককে বলেন, লটারির না হলে মেলা চলে না। কিছুক্ষণ পরে তিনি শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কে আসবেন। দেখা করার অনুরোধ জানান তিনি।
মেলার দায়িত্বে থাকা কালিগঞ্জ সড়ক ও পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মনিরুল ইসলাম মনি ও সামাদ স্মৃতি সংঘের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হামিদ বলেন, মেলা চলছে ঠিকই তবে অনুমোদন বিহীন লটারির চলছে না একথা বলা যাবে না। তবে এটি একটি আনন্দের বিষয় বলে সেখানে যাওয়ার আহবার জানা তারা।
কালিগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এনামুল হোসেন ছোট জানান, মেলায় প্রবেশের টিকিট দিয়ে লটারির করা হয় বলে তিনি জানেন। তবে প্রকাশ্যে লটারির বিক্রির কথা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহোদয় তাকে অবহিত করলে তিনি বিষয়টি মানিক শিকদারকে ডেকে সতর্ক করেছিলেন। তবে আওয়ামী লীগ বা তার অঙ্গ সংগঠণের কোনো নেতা লটারির নিয়ে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নন দাবি করে তিনি বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
কালিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মামুন রহমান বলেন, অনুমতি ছাড়াই লটারির চলছে। তিনি বিষয়টি নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
কালিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রহিমা সুলতানা বুশরা জানান, বিষয়টি নিয়ে তিনি জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। যে কোন সময় লটারির বন্ধ করে দেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মো. হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে রোববার বিভিন্ন সময়ে মোবাইলে যেগোযোগ করেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে মেলার অনুমতিপত্রে স্বাক্ষরকারী নেজারত শাখার নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট বাপ্পি দত্ত রণি বলেন, বিষয়টি তিনি খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেবেন।
প্রতিনিধি/একেবি

