রসে টইটম্বুর রসগোল্লা দেখে কতক্ষণ আর লোভ সামলানো যায়? বসে গেলাম যথারীতি। দেখতে যেমন, স্বাদেও তেমন! এবার লেংচার পালা। মুখে পুরতেই, আহ, কী এক ভীষণ সুখ! এতো মোলায়েম যে মুখে পড়ামাত্রই মিলিয়ে গেল চোখের পলক না ফেলতেই। এককথায় অনন্য। সবশেষে পাতে দই না হলে তো চলেই না, সবমিলে যেন এক ছটাক স্বর্গ।
দই-মিষ্টির জন্য বহুকাল ধরেই লক্ষ্মীপুরে বিখ্যাত বি. সাহা সুইটস। এক সময় বিয়ে বা বড় পরিসরের কোনো আয়োজনে ভালো মিষ্টির সন্ধানে দূরদূরান্ত থেকে রামগঞ্জের সোনাপুর বাজারের এই প্রতিষ্ঠানে আসতে দেখা যেতো বনেদি পরিবারগুলোকে। এখনও সেই ধারা অব্যাহত আছে।
বিজ্ঞাপন

মেঘনা নদীর তীরঘেঁষা এই জনপদে বর্তমানে হরেক মানুষের ভিড় দেখা গেলেও স্থানীয় যে প্রাচীন পরিবারগুলো রয়েছে, ব্যবসায়ী হিসেবেও তাদের সুনাম আজকের নয়। স্বাধীনতার বহু আগে থেকেই হাটবারগুলোয় পাইকারি পণ্যের জন্য একশ ২৫ বছরের পুরোনো বি. সাহা সুইটসে্ বিভিন্ন জেলা থেকে আসতেন ব্যবসায়ীরা।
সদাইয়ের ফাঁকে বাজারে বসে মিষ্টি খাওয়ার প্রচলন ছিল তখন। সেইসময় থেকেই এর আশেপাশের এলাকায় নাম-ডাক ছড়িয়ে পড়ে বি. সাহার মিষ্টির। বর্তমানে রাস্তার ওপরে বাজার বসায় মূল সড়ক থেকে কিছুটা ভেতরে চলে যাওয়ায় প্রাচীন এ বাজারটির গুরুত্ব খানিকটা কমে গেলেও বহাল তবিয়তে চলছে বি .সাহার বিখ্যাত মিষ্টির দোকানটি।
জানা যায়, ১৮৯৮ সালে সোনাপুর বাজারে জগবন্ধু সাহা নামে ১৫-১৬ বছর বয়সের এক কিশোর জিলাপি-মিষ্টি বানানো শুরু করেন। তখনকার দিনে মিষ্টির এতো চাহিদা ছিল না। তবুও প্রতি রোববার ও বৃহস্পতিবার সোনাপুর বাজারে হাট মিলতো। এ দুইদিন বহু দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ জগবন্ধু সাহার দোকানে মিষ্টি খেতে আসতেন। একসময় জগবন্ধু সাহার জিলাপি-মিষ্টি জেলার বিভিন্ন হাটে বিক্রি হতো। এভাবেই জগবন্ধু সাহার মিষ্টির সুনাম আস্তে-আস্তে ছড়িয়ে পড়েন। দীর্ঘ ৪০ বছর যাবত জগবন্ধু সাহা দোকান চালান। ১৯৫৩ সালে তিনি মারা যান।
এরপর তার ছেলে বিশ্বেশ্বর সাহা মিষ্টির দোকানটি পরিচালনা করেন। এভাবেই তার নামেই বি. সাহা সুইটসের নামকরণ হয়।
কৈশোর বয়সে বিশ্বেশ্বর সাহা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর আদর্শে উজ্জীবিত হন। যখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, তখন বিশ্বেশ্বর সাহা ভারতের ত্রিপুরায় ছিলেন। ত্রিপুরা থাকাবস্থায় তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তিনি নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজে সৈনিক হিসেবে কাজ করেন।

বিশ্বেশ্বর ছিলেন সুদর্শন। মঞ্চনাটকে অভিনয় করতেন। তিনি মনে করতেন, মঞ্চনাট্যের মাধ্যমে মানুষের মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা কষ্ট ফুটিয়ে তুলতে পারবেন তাঁর অভিনয় দিয়ে। বিশ্বেশ্বর সাহা নাটকের পাশাপাশি বাবা জগবন্ধু সাহার মিষ্টির দোকানে সময় দিতেন। তার বাবার মৃত্যুর পর থেকে পুরোদমে বিশ্বেশ্বর মিষ্টির দোকানে বসেন। তখন থেকে ধীরে ধীরে তাদের মিষ্টির দোকানটি আরও পরিচিতি পায়।

বিভিন্ন বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ বিশ্বেশ্বর সাহা কাছে পরামর্শের জন্য আসতেন তার মিষ্টির দোকানে। সন্ধ্যার পর তারা দোকানে আড্ডা দিতেন। এভাবে একসময় জগবন্ধু সাহা মিষ্টির দোকান থেকে বিশ্বেশ্বর সাহা মিষ্টির দোকান বিভিন্ন জায়গায় পরিচিত লাভ করে।

বিশ্বেশ্বর সাহা বেঁচে নেই। তার সন্তানরা বি. সাহা সুইটস্ (মিষ্টি) নামে তাদের বাবার রেখে যাওয়া সেই স্মৃতি সুনামের সঙ্গে বয়ে চলেছেন, পরিচালনা করে যাচ্ছেন। রামগঞ্জের মানুষ ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্নস্থান জেলায় বেড়াতে গেলে বি. সাহা সুইটসের মিষ্টি সঙ্গে নিতে ভোলেন না।

প্রতিদিন ঠিক সকাল ৮টায় দোকানটি খোলা হয়। রাত ১০টা পর্যন্ত চলে মিষ্টিমুখের সুযোগ।
বিশ্বেশ্বর সাহার আমলের তুলনায় দোকানটির আকৃতিতে এসেছে পরিবর্তন। বেড়েছে দোকানের পরিসর। একদল মিষ্টিখোর এসে বসছে, পছন্দ অনুযায়ী মিষ্টি খাচ্ছে, খাওয়া শেষ না হতেই হাজির আরও একদল। সবার মুখেই তৃপ্তির হাসি, এ যেন দোকানটির চিরাচরিত দৃশ্য।

তাদের মধ্যে কথা হয় অনিল চন্দ্র সুত্রধর, দীনবন্ধু সুত্রধর ও নজরুল ইসলামের সঙ্গে। তারা জানান, এখানকার মিষ্টি খেতে মজা লাগে। মুখে নিলে খুব সুস্বাদু লাগে। আমরা সবসময় সোনাপুর বাজারে আসলে এ দোকান মিষ্টি না খেয়ে যাই না। আমাদের বাড়িতে মেহমান অথবা কোথায় বেড়াতে গেলে আমরা এ দোকানের মিষ্টি সঙ্গে করে নিয়ে যাই। রামগঞ্জবাসীর জন্য এ মিষ্টি ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি।
তবে বিশ্বেশ্বর সাহার হাত ধরে যখন চালু হয় মিষ্টির দোকানটি, সেসময় কিন্তু মিষ্টির এতো বাহারি ধরন ছিল না। বর্তমানে দোকানটিতে পাওয়া যায় ৯ রকমের মিষ্টি। তার মধ্যে রসগোল্লা, রসমালাই, ক্ষীরচমচম, লেংচা, কাঁচা সন্দেশ, মালাইকারী, ছানার পোলাও, ক্ষীরদই, টকদই উল্লেখযোগ্য।

বৃহত্তর পরিসরে মিষ্টির সুনাম ছড়িয়ে দিতে তাঁর সন্তানরা ঢাকায় বি. সাহা সুইটসের একটি শোরুম দেওয়ার চিন্তা করছেন।
দোকানটিতে ঢুকতেই চোখে পড়লো, ম্যানেজারের আসনে বসে আছেন সমীর রঞ্জন সাহা। তিনি জানালেন, তিনি বিশ্বেশ্বর সাহার মেজ ছেলে।

সমীর রঞ্জন সাহা বললেন, শত বছরের পুরনো আমাদের এ দোকান। মানুষের বিশ্বাসের একটি জায়গা, সেই বিশ্বাসের জায়গা থেকে আমরা লক্ষ্য ও সততা বজায়ে রেখে পণ্য বিক্রি করি। করোনা মহামারিতে আমাদের ব্যবসা কিছুটা লোকসান গুণতে হয়েছে। এরপর থেকে থেকে আবার স্বাভাবিক জায়গায় এসেছে। আমাদের স্বপ্ন আছে, ঢাকায় একটি বি. সাহা সুইটস্ দোকান দেওয়ার।
তিনি জানালেন, ১২৫ বছর পেরিয়ে গেলেও একইরকম জনপ্রিয় দোকানটি।
প্রতিনিধি/এইচই

