শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবায় পিছিয়ে চরের মানুষ

পারভীন লুনা
প্রকাশিত: ০৩ জানুয়ারি ২০২৩, ০৫:০৯ পিএম

শেয়ার করুন:

শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবায় পিছিয়ে চরের মানুষ
ছবি : ঢাকা মেইল

জনগণের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসেবে আমাদের সংবিধানে স্বীকৃত। কিন্তু স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার ৫টি চরের তৃণমূলে স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়নি। উন্নত হয়নি তাদের জীবনমান। অর্থের অভাবে অনেকে চিকিৎসা করাতে পারছেন না, আবার অনেকে ভুল ও অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছেন। এর অন্যতম কারণ, পিছিয়ে পড়া এ জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের অভাব। এতে কার্যকর হচ্ছে না ওই চরগুলোর স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা ব্যবস্থা।

এসব চরে নেই কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নেই কোনো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা কমিউনিটি ক্লিনিক—এমন মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত যমুনার চরের মানুষগুলো। স্কুল না থাকায় অন্ধকারেই থেকে যাচ্ছে চরের ছেলে-মেয়েরা। তারা বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার আলো থেকে। সকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত বাবা-মার সঙ্গে গৃহস্থালির কাজ করে তাদের সময় কাটে। 


বিজ্ঞাপন


সারিয়াকান্দি উপজেলার কর্ণিবাড়ী ইউনিয়নের তালতলা, কোমরপুর, মিলনপুর, চরমাটিয়ান ও বানিয়াপাড়া চর এলাকায় ঘুরে দেখা যায় এমন চিত্র। 

সরকারি-বেসরকারি সবার সঙ্গে সমন্বয় করে তৃণমূল পর্যায় ও চরের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মাঝে স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার কর্মপরিকল্পনা হাতে নিতে হবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। 

bogura

বানিয়াপাড়া চর গ্রামে একটি মক্তব ঘর আছে। তবে তা একেবারেই নড়বড়ে। মক্তব ঘরের দরজা-জানালা কিছু নেই। বালুর মেঝে থাকলেও ঘরের চারপাশের নিচের অংশে নেই কোনো বেড়া। এই তীব্র শীত উপেক্ষা করে মা-বাবার সঙ্গে জমিতে কাজ করছে এই কোমলমতি শিশুরা। অথচ তাদের এখন বই নিয়ে পড়তে বসার কথা।


বিজ্ঞাপন


জানা যায়, বানিয়াপাড়া চরের ৫টি গ্রাম রয়েছে। রয়েছে ১২০টি পরিবার। প্রতিটি ঘরে ২-৩টি করে ছেলে-মেয়ে রয়েছে। এই ৫টি চরে অন্তত প্রায় ১ হাজার পরিবার রয়েছে।

বানিয়াপাড়া চরের বিলকিস বেগম বলেন, ২৬ বছর আগে আমার বিয়ে হয়ে এই চরে এসেছি, আমার দুই মেয়ে।চরে কোনো স্কুল না থাকায় পড়াতে পারিনি। দুই মেয়েকে নিরাপত্তার অভাবে ১০-১১ বছর বয়সেই বিয়ে দিয়েছি।

তিনি আরও বলেন, আমরা চরের বাবা-মায়েরাও শিক্ষার আলো পাইনি, আমাদের ছেলে মেয়েরাও পেল না।

bogura

মিলনপাড়া চর গ্রামের বাবুল শেখ বলেন, ৪-৫ কিলোমিটার দূরে বোহাইল ইউনিয়নের চর মাঝিড়ায় একটি স্কুল রয়েছে। ২-১ জন ছেলে-মেয়ে সেই স্কুলে গেলেও স্কুলে যাওয়ার কোনো রাস্তাঘাট নেই। এছাড়া বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় স্কুলে যাওয়া হয় না চরের ছেলে-মেয়েদের। তাছাড়া স্কুলের শিক্ষকরা একদিন আসলেও সপ্তাহে ৫ দিন অনুপস্থিত থাকেন। আবার যদি থাকেনও তাহলে তারা সময় মানেন না। হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করতে বেলা ১২টায় এসে দুপুর ২টার মধ্যেই চলে যায়। চরের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া হবে কেমন করে। 

তালতলা চরের সখিনা বলেন, আপনাদের মতো সাংবাদিকরা আসে, আর খালি ছবি তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু আমাদের কোনো উপকার হয় না। চরের মানুষের লেখাপড়া কিভাবে সম্ভব? 

কথা হয় চরের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে। তাদের দাবি একটি স্কুল। চিৎকার করে তারা বলতে থাকে—আমরা স্কুল চাই, স্কুল চাই। আমরা পড়ালেখা করতে চাই। আমরা স্কুলে যেতে চাই।

কর্ণিবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়্যারমান আনোয়ার হোসেন দিপন বলেন, আমার ইউনিয়নের অনেকেই উচ্চশিক্ষিত থাকলেও তারা চরের মানুষের শিক্ষার জন্য কোনো কাজ করেন না। চরে রাস্তাঘাট, হাট-বাজার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকায় সেখানকার মানুষেরা অনেক কষ্টের মধ্যে জীবনযাপন করে থাকেন। শিক্ষাসহ জীবনযাত্রার মান বাড়াতে সরকারি উচ্চ মহলকে ভাবা দরকার।

উপজেলার সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার গোলাম কিবরিয়া বলেন, চরে স্কুল ছিল, তবে তা নদী ভাঙার কারণে বাঁধের ওপর তোলা হয়েছে। ৪ বছর আগে উপজেলা শিক্ষা কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১০টি স্কুল চরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়েছিল।

তবে স্কুল কমিটির আদালতে বা কোর্টে মামলার কারণে তা সম্ভব হয়নি। উল্লেখিত চরে স্কুলের প্রয়োজন থাকলেও সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষকরা চরে স্কুলে যায়, কিন্তু তারা সঠিক সময়ে যাওয়া-আসা করেন না। 

আম্বিয়া বেগম নামের এক চরবাসী বলেন, চরের  মানুষ প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা পায় ঠিকই কিন্তু হকারের মাধ্যমে। হকাররা ওষুধ বিক্রি করেন মাইকে। চরে কোনো গর্ভবতী মহিলা সঠিকভাবে স্বাস্থ্য পরামর্শ পায় না। সরকারি কমিউনিটি ক্লিনিক নেই এই চরে। ফলে হঠাৎ করে গর্ভবতী মহিলারা  অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে শহরের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হলে প্রায় একটা যুদ্ধ করতে হয় পরিবারের সদস্যদের। বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে। বালুর রাস্তা পার হয়ে নৌকায় রোগীকে শহরে নিয়ে যেতে যেতেই দেখা যায় রাস্তায় সন্তান প্রসব করেছে। অনেক মা ও শিশু মারা যান এতে। আমরা খুব কষ্টে থাকি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বগুড়ার সদর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সামির হোসেন মিশু বলেন, চরে কমিউনিটি ক্লিনিক আছে, মানুষকে আমরা স্যাটেলাইট প্রোগ্রামের মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকি। কিছু ক্লিনিক নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ায় নতুন জায়গায় হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এটা সত্যি কথা যে চরবাসির বেশির ভাগ স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এর মূল কারণ যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো না। তারা নদী পার হয়ে উপজেলায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেক দেরি করে ফেলেন। আমি মনে করি, চরে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা কমিউনিটি ক্লিনিকের খুব দরকার।

প্রতিনিধি/এইচই

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর