রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

বন্ধ হওয়ার পথে গান্ধীর গড়া তাঁতশিল্প

জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৯ মার্চ ২০২২, ১০:৩৬ পিএম

শেয়ার করুন:

বন্ধ হওয়ার পথে গান্ধীর গড়া তাঁতশিল্প
ছবি : ঢাকা মেইল

এই উপমহাদেশে হস্তচালিত তাঁত শিল্প ছিল জগদ্বিখ্যাত। দেশের চাহিদা মিটিয়ে সব সময় এই তাঁতের কাপড় বিদেশেও রপ্তানি হতো। একটি পেশাজীবী সম্প্রদায় তাঁত শিল্পের সাথে তখন জড়িত ছিলেন। তাদেরকে স্থানীয় ভাষায় বলা হতো ‘যুগী’। ভারতে গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে ঐতিহাসিক কারণে এ অঞ্চলে তাঁতশিল্প দ্রুত বিস্তার লাভ করে। বিদেশি কাপড় বর্জনের ডাকে যখন ব্যাপক হারে চরকায় সুতা কাটা শুরু হয়। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে উপমহাদেশে হস্তচালিত কাঠের তৈরি চরকা দিয়ে শুরু হয় তাঁত শিল্পের। তাঁতিরা তাতে কাপড় বুনতেন। এসব তাঁতে তৈরি হতো লুঙ্গি, শাড়ি, গামছা ও ধুতিসহ বিভিন্ন পোশাক, যা গ্রামীণ জনপদের মানুষের পোশাকের চাহিদা পূরণ করতো। 

১৯২১ সালে দেশি কাপড় তৈরি ও পরিধানে ডাক দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। ১৯৪৭ সালের ২৯ জানুয়ারি নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি উপজেলার জয়াগে আসেন তিনি। সেখানকার তৎকালীন জমিদার ব্যারিস্টার হেমন্ত কুমার ঘোষ তার সকল সম্পত্তি গান্ধীজির আদর্শ প্রচার এবং গান্ধীজির স্মৃতি সংরক্ষণে একটি ট্রাস্টের মাধ্যমে জন্য দান করেন, প্রতিষ্ঠা করা হয় একটি ট্রাস্ট। ট্রাস্টটির নামকরণ করা হয় ‘কালিগঙ্গা চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’। ১৯৭৫ সালে তার নাম পরিবর্তন করে করা হয় ‘গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট’। সোনাইমুড়ির সেই তাঁতশিল্প মহাত্মা গান্ধীর স্মারক হয়ে এখনও টিকে থাকলেও নেই সেই জৌলুস।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে চৌমুহনীতে আরেকটি তাঁত ছিল। তাতে জামদানি শাড়ি বুনন করা হতো। জানা যায়,  মো. রাসেল নামে একজন ঢাকায় এক তাঁতে চাকরি করতেন, যেখানে জামদানি শাড়ি বুনন করা হতো। পরে তিনি নিজে তাঁত দেওয়ার চিন্তা করে চৌমুহনীর মধ্য জিরতলী গ্রামে তার বাড়িতেই (ছদর উদ্দিন ফরজি বাড়ি) তাঁত দেন। সেখানে জামদানি শাড়ি বোনা হতো। তার স্ত্রীও সাহায্য করতেন। প্রচার ও বিক্রি কম থাকায় লোকসানে পড়েন তিনি। সাত বছর আগে রাসেল ওই তাঁত বন্ধ করে জীবিকার কারণে বিদেশে চলে যায়। এছাড়া করোনায় সুতার দাম বাড়তি ও তাঁতিদের খরচ বহন করতে না পেরে জেলা সদরে বিনোদপুরে এনআরডিএস পরিচালিত তাঁতও বন্ধ হয়ে যায়। 

গান্ধী আশ্রম-১

২০০৩ সালে গান্ধী আশ্রমে চালু করা হয় একটি তাঁতশিল্প। প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিবছর ওই তাঁতে তৈরি প্রায় অর্ধকোটি টাকার কাপড় বিক্রি হতো। কিন্তু ২০১৯ সালে করোনা  সংক্রমণ শুরুর পর থেকে প্রতিষ্ঠানটিতে কমতে থাকে উৎপাদন। বিক্রি কমে যাওয়া, পাইকার না থাকায় প্রতিষ্ঠানটি প্রায় বন্ধের পথে বলে জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষ, প্রতিমাসে তাদেরকে গুণতে হচ্ছে লোকসান। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এবং তাঁতশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারিভাবে প্রণোদনামূলক পদক্ষেপ নেয়া হলে এ শিল্পটি আবার তার পুরনো দিন ফিরে পাবে এমনটা প্রত্যশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।   
 
প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, ২০০৩ সালে প্রথমে ১০ জন নারী শ্রমিক নিয়ে যাত্রা শুরু করে। পরবর্তীতে ২৬টি হস্তচালিত মেশিনে কর্মসংস্থান হয় ৭০ জন নারীর। মজুরিভিত্তিতে তাঁতটিতে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের আশপাশের ৭০টি পরিবারের নারী সদস্যদের কর্মসংস্থান হওয়ায় তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা পরিবর্তন হতে শুর” করে। এর বাইরে বেতন ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয় একজন ম্যানেজারসহ আরও ৯ জন। দিনপ্রতি পণ্য তৈরির ওপর মজুরি দেওয়া হতো শ্রমিকদের, দুপুরে খাওয়া বাবদ দেওয়া হতো ৫০ টাকা করে।  

গান্ধী আশ্রম-২


বিজ্ঞাপন


এখানে তৈরি পাঞ্জাবি, কটি, শাড়ি, শাল, ওড়না, থ্রি-পিস, টু-পিস, ফতুয়া, উত্তরীয়, কাপড়ের পঞ্জিকা, কবি ব্যাগ, গামছা, শিশুদের পোষাক, তোয়ালে, বেডশিট, রুমাল, মাস্ক, থান কাপড় এলাকার চাহিদা পূরণ করে পাইকার ও এজেন্টের মাধ্যমে সারাদেশের বিভিন্ন বিক্রয় কেন্দ্রে বিক্রি করা হতো। ইতিমধ্যে কয়েকটি অনলাইন বিক্রেতার মাধ্যমে পণ্য বিক্রি শুরু করা হয়েছে।

২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে করোনার প্রভাব পড়ে এ তাঁতে। লকডাউনসহ বিভিন্ন বিধি-নিষেধে কমতে থাকে বাইরে থেকে আসা পাইকার। করোনায় প্রতিদিনই কমতে থাকে বিক্রি। বিক্রি কমে যাওয়ায় উৎপাদনও কমে যায়। ফলে ২০১৯ সালের শেষের দিক থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পণ্যের উৎপাদন কমে যাওয়ায় মাত্র ১৭ জন শ্রমিক রেখে ৫৩ জনকে ছাঁটাই করে দেওয়া হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠানের ২০টি তাঁত মেশিন।  

আরও জানা যায়, ২০০৬ সালে যাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতিবছর এ প্রতিষ্ঠানের ২৬টি তাঁত থেকে তৈরি হওয়া প্রায় অর্ধকোটি টাকার পণ্য দেশেরা বিভিন্ন স্থানে পাইকারি ও খুচরা মূল্যে বিক্রি করা হতো। তাঁতের নিজস্ব বিক্রি কেন্দ্রের বাইরে প্রায় প্রতিটি জেলায় পাইকারের মাধ্যমে পণ্য পৌঁছে দেওয়া হতো। গত ৬ বছরে প্রতিষ্ঠানটিতে বিক্রি কমেছে প্রায় ৪৫ লাখ টাকা। যেখানে ২০১৫ সালে বিক্রি ছিল অর্ধকোটি টাকা। ২০২০ সালে নেমে আসে সোয়া ৬ লাখ ১০ হাজার টাকায়, ২০২১ সালে ছিল ৬ লাখ টাকা। যা করোনার শুরুতে ২০১৯ এ ছিল সাড়ে ১৬ লাখ টাকা।
  
চরকা শ্রমিক রুমা আক্তার জানান, চরকার মাধ্যমে বোভিন, চানা কাটা, তুলা কাটার ও সুতা রঙয়ের কাজ করেন তিনি। গত ১০ বছর ধরে এক কাজের বাইরে আর কিছু তার জানা নেই, বর্তমানে তাঁতটির যে অবস্থা যে কোন মুহূর্তে সেটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর তাতে চাকরি হারিয়ে ফেললে আর কোথাও কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই তার। 

গান্ধী আশ্রম-২

তাঁত শ্রমিক পারভীন বলেন, ‘দুই বছর আগেও আমরা যে পরিমাণ কাজ করতাম তাতে প্রতিদিন গড়ে ৪ থেকে ৫ শত টাকা মজুরি পেতাম। কিন্তু বর্তমানে বিক্রি কমে যাওয়ায় কাপড় তৈরিও কমে গেছে, এখন প্রতিদিন ১৫০-২০০ টাকা মজুরি পেতেও কষ্ট হয়। এভাবে চলতে থাকলে পরিবার ও সন্তানদের পড়ালেখা নিয়ে বিপাকে পড়তে হবে।’

মিনতি রানী শীল নামের আরেক তাঁত শ্রমিক জানান, আমাদের এলাকার অনেক গরীব মেয়েরা এ তাঁতে কাজ করতো। কিন্তু করোনার কারণে আমাদের তাঁতটি এখন বন্ধের মতো পড়ে আছে। গরীব মেয়েগুলো কাজ হারিয়ে পরিবার নিয়ে কষ্টে আছে। তাঁতটি পুনরায় চালু হলে সবাই আবার কাজ ফিরে পাবে।  

পারভিন লাকী নামের একজন ক্রেতা জানান, তিনিসহ তার দুইজন সহকর্মী ঢাকা থেকে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের জাদুঘরে ঘুরতে এসেছেন। এখানে তাঁতে কাপড় তৈরি হয় বিষয়টি জানতে পেরে আশ্রমের খুচরা বিক্রি কেন্দ্রে থেকে একটি পাঞ্জাবি, একটি কটি ও তিনটি শাল ক্রয় করেছেন। 

হস্তচালিত তাঁতে তৈরি হওয়া পণ্যগুলোর গুণগত মান অনেক ভালো বলে জানান এ ক্রেতা।

সোনাইমুড়ি বাজারে কাপড় ব্যবসায়ী মনির হোসেন বলেন, বাজারে তাঁতে তৈরি পণ্যের চাহিদা প্রচুর ছিল, গুণগতমান ভালো হওয়ায় বিশেষ করে নারীদের শাড়ি, থ্রি-পিস, টু-পিস, থানকাপড় ও শাল বিক্রি ছিল লক্ষণীয়। প্রতি মাসে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার তাঁতের তৈরি পোশাক আমার দোকানে বিক্রি হতো। কিন্তু হঠাৎ করে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে দোকানের অন্য মালামালের সাথে কাপড় বিক্রিও অনেক কমতে শুরু করে। মানুষের আর্থিক সংকটের কারণে এমন সমস্যা হয়েছে বলে ধারণা করেন তিনি। এ বিক্রেতা আরও জানান, শপিংমল ও বড় দোকানগুলোতে বিক্রি কমলেও ফুটপাতের হকারদের স্টলগুলোতে কিছু ক্রেতা দেখা যায়।  

গান্ধী আশ্রম তাঁতের খুচরা বিক্রি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার মিরুপা ইয়াছমিন জানান, প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনি ম্যানেজার হিসেবে কমর্রত আছেন।  শুরু থেকে যে পরিমাণ পণ্য বিক্রি ছিল, তার কিছুই এখন নেই। এক করোনার কারণে আমাদের প্রতিষ্ঠানটি আজ বন্ধের পথে। পাইকার না থাকায় বাজারে পণ্য পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না, তাই বাধ্য হয়ে উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। 

গান্ধী আশ্রম-৫

গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের পরিচালক রাহা নবকুমার জানান, স্থানীয়দের আত্মনির্ভশীলতার উদ্দেশ্যে এখানে তাঁত শিল্প প্রতিষ্ঠা করা হয়, কর্মসংস্থান হয় প্রায় শতাধিক নারীর। ঢাকা থেকে সুতা এনে এ তাঁতে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া তুলা থেকেও চরকার মাধ্যমে আমরা নিজেরা সুতা তৈরি করে থাকি। প্রতিষ্ঠানের শুরু থেকে আমরা সফলতার সাথে আমাদের পণ্যগুলো দেশের বড় বড় বুটিং হাউজে বিক্রি হয়। প্রায় তিনশত ধরনের কালারসেট আমাদের এখানে তৈরি করা হয়। কিন্তু করোনার কারণে বুটিং হাউজগুলোতে চাহিদা না থাকায় আমাদের প্রতিষ্ঠানটি প্রায় বন্ধের পথে। তাঁত শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারিভাবে উদ্য্যেগ গ্রহণ করা জরুরি। তাছাড়া শিল্পটিকে পুনরুদ্ধার করতে হলে তাঁতিদের অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে লোনের ব্যবস্থা করতে হবে।

তিনি আরও জানান, বর্তমানে শ্রমিক, কর্মকর্তা ও বিদ্যুৎ বিল বাবদ প্রতি মাসে প্রতিষ্ঠানটির খরচ হচ্ছে দেড় লাখ টাকা। কিন্তু যে পরিমাণ পণ্য তৈরি হচ্ছে তার তুলনায় লোকসানে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

এইচই

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর