সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

দুলালের ডাকে ছুটে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি

মো. লিটন হোসেন লিমন
প্রকাশিত: ৩০ অক্টোবর ২০২২, ১০:২২ এএম

শেয়ার করুন:

দুলালের ডাকে ছুটে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি
ছবি: ঢাকা মেইল

‘তোতা-ময়নারা আয় আয় আয়, জান ময়নারা আয় আয় আয়। খেয়ে যা, খাবার সময় হয়েছে, আয় আয় আয়’ এমন মুধুর সুরে ডাকলেই ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসে পাখি। প্রতিদিন সকাল-বিকেল শালিক, বুলবুলি, চড়ুই, ময়নাসহ নানা প্রজাতির শত শত পাখি উড়ে আসে পাখি প্রেমী দুলাল হোসেনের (৭০) এমন ডাকে।

দুলাল জোড়মল্লিকা গ্রামের মৃত কাচু প্রমাণিকের ছেলে। পরিবারে স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। ঝালমুড়ি বিক্রি করে প্রতিদিন যা আয় করেন তা দিয়ে চলে তার সংসার ও পাখিদের খাবার।

দুলাল হোসেন নাটোরের সিংড়া উপজেলার জোড়মল্লিকা গ্রামের বাসিন্দা। পেশায় তিনি একজন ঝালমুড়ি বিক্রেতা। কিন্তু এলাকার মানুষের কাছে তিনি পাখি প্রেমী হিসেবেই পরিচিত। প্রতিদিন সকাল-বিকেল দুবেলা দুলালের হাকডাকে ছুটে আসে নানা প্রজাতির শত শত পাখি। পাখিদের খাবার শেষ হলেই তিনি ফিরে যান কাজে। এভাবে প্রায় ৫ বছর ধরে পাখিদের ভালোবেসে খাবার দিয়ে চলেছেন বৃদ্ধ দুলাল। পাখিদের প্রতি দুলালের এমন ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ অনেকেই। পাখিদের সঙ্গে তার এমন মধুর সম্পর্ক এলাকায় বেশ আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। এলাকায় কেউ পাখি ধরতে বা শিকার করতে চাইলে তিনি তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।

nator

দুলাল জোড়মল্লিকা গ্রামের মৃত কাচু প্রমাণিকের ছেলে। পরিবারে স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। ঝালমুড়ি বিক্রি করে প্রতিদিন যা আয় করেন তা দিয়ে চলে তার সংসার ও পাখিদের খাবার।

শনিবার (২৯ অক্টোবর) বিকেলে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, উপজেলার জোড়মল্লিকা গ্রামে হাতে চানাচুর নিয়ে পাখিদের ডেকেই চলেছেন দুলাল। তার ডাকে সারা দিয়ে পাখিরা খেতে হাজির হয়েছে। চানাচুর ছিটিয়ে ডেকে ডেকে পাখিদের খাওয়াচ্ছেন তিনি। পাশেই দূর-দুরান্ত থেকে আসা অনেক মানুষ পাখি দেখতে জড়ো হয়েছেন।


বিজ্ঞাপন


সেই পাখিপ্রেমী ঝালমুড়ি বিক্রেতা দুলাল হোসেনের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা মেইলের প্রতিবেদকের। তিনি জানান, ছোটবেলা থেকেই তার পাখিদের প্রতি একটা টান ছিল। সেই টান থেকেই পাখিদের প্রতি এমন ভালোবাসা। প্রথম দিকে খাবার ছিটালে কিছু পাখি আসলেও পরবর্তীতে তার সঙ্গে পাখিদের সম্পর্ক মধুর হয়ে যায়। তার ডাকে এখন শত শত পাখি হাজির হয়। দুলাল ও পাখিদের ভালোবাসার দৃশ্য দেখতে প্রতিদিন মানুষ তার দোকানে ভিড় জমায়। পাখিদের কখন আপন করে নিয়েছে তা নিজেও তিনি জানেন না। পাখিদের না দেখলে তার বুকের ভিতরে ঝটপট করতে থাকে।

nator

দোকানে শত ব্যস্ততায় থাকলেও পাখিদের খাবারের কথা ভুলেন না তিনি। পাখিদের চানাচুর মাটিতে ছিটিয়ে ডাকতেই তার ডাকে সাড়া দেয় ঝাঁক ঝাঁক নানা প্রজাতির পাখি। তার সঙ্গে পাখিদের আত্মার এক বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে। তিনি পাখিদের সন্তানের মতোই আপন করে নিয়েছেন বলেও জানান তিনি।

পাখিপ্রেমী দুলাল হোসেন বলেন, ‘প্রতিদিন খাবার ছিটিয়ে তাদের জন্য বসে থাকি। দিনে দিনে পাখিদের সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে প্রতিদিন পাখিদের জন্য ১১০ টাকার চানাচুর লাগে। নিজের পরিশ্রমের অর্থ দিয়ে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করি। কখনো কখনো নিজে না খেয়েও তাদের খাবার জোগার করি। তারা খেলে আমার প্রশান্তি লাগে, মনে তৃপ্তি লাগে।’

আবেগআপ্লুত হয়ে দুলাল আরও বলেন, ‘২০ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে রাজনীতি শুরু করি। দলের জন্য অনেক ত্যাগ করেছি। এখন আর কেউ খোঁজও নেয় না আমার। কিছুদিন আগে মানুষের আশ্বাসে মেম্বার পদে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলাম। নির্বাচনে আমার যা টাকা-পয়সা ছিল সবকিছু ফুরিয়েছি। যে মানুষের আশ্বাসে নির্বাচন করলাম, তারাই আমার সঙ্গে বেঈমানি করেছে। নির্বাচনে পরাজিত হই। মানুষ বেঈমানি করলেও কখনো পশু-পাখিরা বেঈমানি করবে না। তাই যত দিন আমি বাঁচবো, তত দিন এ ভাবে পাখিদের ভালোবেসে যাবো।’

nator

স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুস সালাম জানান, পাখিপ্রেমী দুলালের সঙ্গে পাখিদের ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। পাখিদের সঙ্গে মানুষের এমন সম্পর্ক হতে পারে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। তিনি প্রতিদিন পাখিদের খাবার দেন। তার ডাকে পাখিরা ছুটে আসে।

আরেক বাসিন্দা মো. বরকতুল্লাহ জানান, অনেক বছর থেকে দেখি তিনি পাখিদের নিয়মিত খাবার দেন। তার ডাকে এক সঙ্গে প্রচুর পাখি জড়ো হয়। সত্যিই তা ‍অসাধারণ। পাখিদের সঙ্গে তার যে একটা সুসম্পর্ক তা দেখতে প্রতিদিন তার দোকানে মানুষ ছুটে আসেন। পাখির সঙ্গে এমন ভালোবাসার খবর এলাকার মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে।

নাজিম উদ্দিন নামে স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, ‘দুলাল পাখিদের ভালোবেসে প্রতিদিন সকাল-বিকেল খাবার দিয়ে থাকেন। তার ডাকে পাখিরা ছুটে আসে। অন্য কেউ ডাকলে কখনো আসে না। তার সঙ্গে পাখিদের এক মহব্বতে পরিণত হয়েছে। তিনি গরীব হলেও তার মনটা অনেক বড়। পাখিদের খাবারের পিছনে তিনি প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০ টাকার ব্যয় করেন। তার মতো এমন পাখিপ্রেমী ও মহৎ মানুষ কখনো দেখিনি। তার পাখিদের প্রতি ভালোবাসা দেখতে বহু দুর থেকে মানুষ আসে।’

nator

সিংড়া পরিবেশ ও প্রকৃতি আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আবু জাফর সিদ্দিকী ঢাকা মেইলকে জানান, দুলাল হোসেন একজন বৃদ্ধ মানুষ হিসেবে পাখির প্রতি যে ভালবাসা দেখিয়েছেন তা অনন্য। পরিবেশ ও প্রকৃতি বাঁচাতে তিনি এগিয়ে এসেছেন। পাখিসহ সকল জীববৈচিত্র রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসা দরকার। আমাদের উচিত জীবের প্রতি ভালবাসা ও সহমর্মিতা দেখানো।

নাটোরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) শামীম আহমেদ ঢাকা মেইলকে জানান, একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হয়েও দুলালের পাখির প্রতি যে মমতা ও ভালোবাসা দেখিয়েছেন তা এক মহৎ কাজ। তিনি নিজ অর্থে প্রতিনিয়তই শত শত পাখিদের খাবারের ব্যবস্থা করছেন। পাখিদের প্রতি তার এমন ভালোবাসা তা অনন্য। তাকে দেখে সমাজের অনেক ব্যক্তি পাখিসহ জীববৈচিত্র রক্ষায় এগিয়ে আসবে বলে আশা করছি।

টিবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর