বর্ষাকালে মুগ্ধকর অপরূপ জলরাশি। কখনও উত্তাল, আবার কখনও নিরব-স্থির। চোখধাঁধানো জলরাশির মাঝে পাল উড়িয়ে ঘুরছে ডিঙি নৌকা। আর হেমন্ত, শীত ও বসন্তে জেগে ওঠে ধুধু বালুর চর। দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগমাধ্যম এই দুই সেতুর তলদেশ দিয়ে বয়ে চলা নদীর বুকে জেগে ওঠা চরই যেন মনে করিয়ে দেয় কোনও সমুদ্র সৈকতের আবেগ। কূল থেকে অপূর্ব সূর্যাস্ত! চারিদিকে কোলাহল মুক্ত সবুজের বেস্টনি। কী অপরুপ দৃশ্য!
বলছিলাম একদিকে অপরূপ সৌন্দর্য আর অপরদিকে প্রজন্মের সাক্ষী হয়ে শতবর্ষ পেরিয়ে আজও বীরদর্পে দাঁড়িয়ে থাকা বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ সেতুর কথা। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম সেতুবন্ধন তৈরি করেছে এই দুই ব্রিজ। প্রতিদিন পাবনা ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা এসে ভিড় জমান এখানে। এছাড়া প্রতি বছর বিদেশি পর্যটকদেরও আনাগোনা দেখা যায় এখানে।
বিজ্ঞাপন
নির্মাণের ১০০ বছর পেরিয়ে গেলেও উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী এই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ স্বচক্ষে দেখার কৌতূহল আজও মানুষের মনে রয়ে গেছে। রূপ-মাধুর্যে ভরা পাকশীর জোড়া সেতু এলাকায় প্রায় প্রতিদিনই মানুষের ভিড় থাকে। বিশেষ করে শুক্রবার ও ছুটির দিনগুলোতে এখানে ভীড় আরও বেশি থাকে। দৃষ্টিনন্দন জোড়া ব্রিজের পাদদেশে এমন প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য ও শান্ত পরিবেশে পাবনা ও আশপাশের জেলাগুলো থেকে মানুষ পরিবার ও বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ছুটে আসেন।
সম্প্রতি এটি আরও জনপ্রিয় এবং ভ্রমণ-পিপাসুদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। কারণ পদ্মার পাড়ে তৈরি হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যাকে ঘিরে চলছে মহাকর্মযজ্ঞ। এছাড়াও পাকশী মানুষের চাহিদার অন্যতম কারণ-ঐতিহ্যবাহী পাকশী পেপার মিল, ফুরফুরা শরীফ, ঈশ্বরদী বিমানবন্দর, বিশাল অঞ্চল নিয়ে পশ্চিম রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় কার্যালয়, বিবিসি বাজার ও রিসোর্টসহ ঐতিহাসিক বিভিন্ন স্থাপনা।
বাংলাদেশের পাবনা জেলা আর কুষ্টিয়া জেলাকে সংযুক্তকারী রেলসেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজ যা বাংলাদেশের দীর্ঘতম রেলসেতু। এই রেলসেতুটি পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশি থেকে কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলা পর্যন্ত সংযুক্ত করেছে। এই ব্রিজ স্থাপনের এক বিশাল ইতিহাস রয়েছে।
বিজ্ঞাপন
জানা যায়, ১৮৮৯ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার কলকাতার সঙ্গে আসাম, ত্রিপুরাসহ উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এই ব্রিজ তৈরির প্রস্তাব করেছিলেন। সেই সময়ে প্রস্তাবটি কার্যকরী না হলেও তার কয়েক দশক পর ১৯০৯ সাল থেকে ব্রিজটি নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়। এই ব্রিজ নির্মাণের সময়কাল ছিল ১৯০৯ থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত।
এটি নির্মাণে ২৪ হাজার ৪০০ শ্রমিক অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন এবং তৎকালীন হিসাব অনুযায়ী এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল ৩ কোটি ৫১ লাখ ৩২ হাজার ১৬৪ ভারতীয় রুপি। তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের নাম অনুসারে ব্রিজটির নামকরণ করা হয়েছিল হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৭৯৮ দশমিক ৩২ মিটার বা ৫ হাজার ৮৯৪ ফুট বা ১ দশমিক ৮ কিলোমিটার। এর ওপরে রয়েছে দুইটি ব্রডগেজ রেললাইন। এই ব্রিজটির নকশা করেছিলেন আলেকজান্ডার মেয়াডোস রেন্ডেল।
ব্রিজটিতে স্প্যান রয়েছে মোট ১৫টি এবং প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য ১২০ মিটার। ঐতিহ্যবাহী এই হার্ডিঞ্জ ব্রিজটি চালু করা হয়েছিল ১৯১৫ সালের ৪ মার্চে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী এই ব্রিজের ওপর দিয়ে ট্যাংক, যুদ্ধসরঞ্জামসহ সৈন্যও পারাপার করত। ফলে মিত্র বাহিনীর যুদ্ধবিমান থেকে এই ব্রিজের ওপর বোমা ফেলা হয়েছিল। এতে ব্রিজের ১২ নম্বর স্প্যান ভেঙে গিয়েছিল এবং ৯ ও ১৫ নম্বর স্প্যান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যা পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ সরকারের সাহায্যে মেরামত করা হয়েছিল। এরপর ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর থেকে পুনরায় ব্রিজটির ওপর দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হয়।
শৈল্পিক কারুকার্যে খচিত বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক লাল রঙা এই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ১০০ বছর পেরিয়ে এখনও দর্শনার্থীদের মন আকৃষ্ট ও মুগ্ধ করে চলেছে। এই ব্রিজটির ঠিক পাশ দিয়েই ২০০৪ সালে তৈরি করা হয়েছে একটি সড়ক সেতু। কুষ্টিয়া জেলার বিখ্যাত সাধক ফকির লালন শাহের নামানুসারে এটির নামকরণ করা হয়েছে লালন শাহ সেতু। যা পদ্মার বুকে ঐতিহ্যবাহী হার্ডিঞ্জ ব্রিজের সঙ্গে এক অপরূপ সৌন্দর্যে মিলেমিশে রয়েছে।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ সেতুর অপরূপ দৃশ্য এবং ইতিহাসে সমৃদ্ধ যুগল ব্রিজের স্থানটিতে একটি আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে সরকার যেমন রাজস্ব পেতে পারে ঠিক তেমনি মানুষ আরও গভীর মুগ্ধতায় পাকশীর অপরুপ সৌন্দর্যভোগ করতে পারতো বলে মনে করেন স্থানীয় সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গ এবং এখানে ঘুরতে আসা পর্যটকেরা।
এইচই/এএ

