শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

অসময়ে হলুদ তরমুজ চাষে ১০ গুণ বেশি লাভ দেখছেন জয়পুরহাটের চাষিরা

জনি সরকার 
প্রকাশিত: ১৯ আগস্ট ২০২২, ০৭:৪১ এএম

শেয়ার করুন:

কৃষির উপর নির্ভরশীল দেশের উত্তরের জেলা জয়পুরহাট। ধান ও আলুর উৎপাদনে উদ্বৃত্ত জেলা জয়পুরহাটের কৃষকরা এবার গ্রীষ্মকালীন তরমুজ ইয়েলো গ্রিন, ব্ল্যাকবেরি, মধুমালা, জেসমিন ও তাইওয়ানের গোল্ডেন ক্রাউনসহ কয়েক রকমের তরমুজ চাষে সফলতা অর্জন করেছে। কম খরচে অধিক লাভ আর বারোমাস ফলন হওয়ায় এ তরমুজ চাষে ঝুঁকছেন এই অঞ্চলের চাষিরা। নিজ জেলার চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে মাচা পদ্ধতিতে বিদেশি নানান জাতের ওই তরমুজের চাষ। 

>> আরও পড়ুন: নেকমরদে বিক্রি হয় লাখ টাকার মাছ ধরার ফাঁদ

পাঁচবিবি উপজেলার শিরট্টি, ভূতগাড়ি ও মাধাইনগর এলাকার কয়েকটি গ্রাম ঘুরে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কম খরচে বেশি লাভ হওয়ায় অন্য ফসল বাদ দিয়ে অসময়ের ফসল এ তরমুজ চাষে ঝুঁকছেন এলাকার কৃষকরা। সাধারণ সময়ে ক্ষেতে তরমুজ যখন শেষ, তখন (আগস্ট মাসে) মাচায় মাচায় ঝুলছে চায়না ও থাইল্যান্ডের মধুমালা আর তৃপ্তি জাতের তরমুজ। বাজারমূল্য অনেক ভালো হওয়ায় ধানসহ অন্যান্য ফসল বাদ দিয়ে কালচে ও হলুদ রঙের তরমুজ চাষে ঝুঁকেছেন এখানকার কৃষকরা। খাদ্য গুণাগুণে সমৃদ্ধ এ ফলের ভেতরে দেখ লাল ও রসাল, খেতেও অনেক সুস্বাদু এবং মিষ্টি। ফলে বাজারে এ তরমুজের চাহিদাও অনেক বেশি। বর্তমানে এ তরমুজ জেলার বিভিন্ন আনাচে কানাচে বিক্রির পাশাপাশি পাঠানো হচ্ছে ঢাকা, রাজশাহী, বগুড়া, নওগাঁ, নাটোরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
tormujজেলার পাঁচবিবি  উপজেলার আওলাই ইউনিয়নের ভূতগাড়ি গ্রামের সোহেল, সুজাউল, ডাবলু, দুলু মিয়াসহ অনেকেই বিদেশী জাতের ওই তরমুজের চাষ করছেন। জমিতে বেড করে মাটির সঠিক আর্দ্রতা ধরে রাখতে মালচিং পেপার দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। ১৮ ইঞ্চি ফাঁকে জুন মাসে চায়না ও থাইল্যান্ডের মধুমালা আর তৃপ্তি জাতের তরমুজের বীজ রোপণ করেন কৃষকেরা। পুরো ক্ষেতে বাঁশের খুঁটি ওপরে চিকন দড়ি  জালের মতো করে বিছিয়ে মাচা তৈরি করা হয়েছে। মাত্র ৪০ দিনের মধ্যে গাছে ফুল ও কুঁড়ি আসে। আর ৭০-৮০ দিনে পরিপক্ব হয়ে মাচার ডগায় ডগায় ঝুলে পড়ে হলুদ, কালো, ডোরাকাটা নীল রঙের এ তরমুজ। ওই সব তরমুজের ওজন আড়াই থেকে চার কেজি। এখানের তরমুজগুলো বিষ ও ফরমালিনমুক্ত ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ বলে দাবি চাষিদের। চাহিদা বেশি, ভালো দাম পাওয়ায় খুশি বলেও জানান তারা। অন্যান্য ফসলের মতো তরমুজ বিক্রির জন্য বাজারে যেতে হয় না। ব্যবসায়ীরা ক্ষেত থেকে সরাসরি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।
tormujহাজীপাড়া গ্রামের সফল তরমুজ চাষি পাপ্পু মন্ডল বলেন, পাশের গ্রাম ভূতগাড়ী এলাকায় তরমুজ চাষ হচ্ছে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে আমার ১০ শতাংশ জমিতে বেড করে চায়না ও থাইল্যান্ডের মধুমালা জাতের তরমুজের বীজ বপন করি। ৪০ দিনের মধ্যে গাছে প্রচুর ফুল ও কুড়ি আসে। এখন মাচায় ডোগায় ডোগায় দোল খাচ্ছে আড়াই থেকে চার কেজি ওজনের তরমুজ। তরমুজগুলো কাটলে ভেতরে টুকটুকে লাল, রসাল আর খেতে মিষ্টি ও খুব সুস্বাদু। বর্তমান বাজারে এ তরমুজের চাহিদা অনেক বেশি, দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিটি তরমুজ গড়ে দুইশ থেকে আড়াইশ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খরচ বাদে প্রায় দেড় লাখ টাকার তরমুজ বিক্রি করার আশা করছেন পাপ্পু মন্ডল।


বিজ্ঞাপন


>> আরও পড়ুন:  তাইওয়ানের রেড লেডি এখন পার্বত্য চট্টগ্রামে দারুণ জনপ্রিয়

পাশের তরমুজ চাষি দোলন কুমার বলেন, এক সময় ধান, আলু, বেগুনসহ অন্যান্য ফসল আবাদ করতাম। অনেকেই বিদেশী জাতের তরমুজ চাষ করছে দেখে আমি এবার পরীক্ষামূলকভাবে ১ বিঘা জমিতে তিনরকম জাতের তরমুজ চাষ করেছি। ১ বিঘায় খরচ হয়েছে ১২ হাজার টাকা। এ পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ টাকার তরমুজ বিক্রি হয়েছে বলে জানান দোলন কুমার। বলেন— জমিতে থাকা তরমুজ বিক্রি হবে আরও প্রায় ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। সবকিছু মিলিয়ে খরচ বাদে প্রতি বিঘা জমিতে লাভ থাকবে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা।
tormuj
 এদিকে দেখা গেল তরমুজের ক্ষেত দেখতে ভিড় করছেন বিভিন্ন এলাকার লোকজন। আবার কেউ কেউ তরমুজ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন জমি থেকে। অসময়ের এ তরমুজ বাজারে বিক্রি হয় ৮০-৯০ টাকা কেজি দরে এবং জমির পাশে রাস্তায় বিক্রি হয় বাজার ৪০-৫০ টাকা কেজি।

কথা হয় তরমুজ ক্ষেত দেখতে আসা ইলিয়াস, আলমগীর হোসেন, কনকসহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা বেশ কয়েকনের সঙ্গে। তারা বলেন, অসময়ে তরমুজ চাষ হচ্ছে এবং এর ফলনও বেশ ভালো। এছাড়া স্বাদ ও গুণগতমান ভালো হাওয়ায় এখন আগ্রহভরে তরমুজ চাষের জন্য পরামর্শ নিতে আমাদের মতো অনেকেই আসছেন।

>>আরও পড়ুন: রসে ভরা রাঙামাটির ‘হানিকুইন’
 
জয়পুরহাট পৌরশহরের স্থানীয় তরমুজ ব্যবসায়ী বেলাল তালুকদার বলেন, ‘আওলাই ইউনিয়নের উৎপাদিত তরমুজগুলোর গুণগত মান অনেক ভালো। এ এলাকার তরমুজ বিষ ও ফরমালিনমুক্ত হওয়ায় ক্রেতাদের চাহিদা অনেক বেশি। বর্তমানে প্রতি মণ তরমুজ ১ হাজার ৮শ থেকে ২ হাজার পর্যন্ত টাকা দরে পাইকারী কিনে ঢাকা, রাজশাহী, বগুড়া, নওগাঁ, নাটোরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হচ্ছে।
tormujজানা গেছে, ২০১৮ সালে সর্বপ্রথম জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলার আওলাই ইউনিয়নের ভাড়াহুত গ্রামের কৃষক আবু মুসা মাত্র আড়াই শতক জমিতে মাচায় ব্ল্যাকবেরি ও মধুমালা তরমুজ চাষ শুরু করেন। মাত্র ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা খরচ করে এ তরমুজের চাষ করে ৭০ দিনে লাভ হয় ২২ হাজার টাকা। তার এ সাফল্য দেখে জেলার বিভিন্ন এলাকায় তরমুজ চাষ ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে জেলার তিনটি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৪০০ বিঘার বেশি  জমিতে এই তরমুজের চাষ চলছে। 

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, কৃষি অফিসের উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে এলাকার কৃষকেরা অসময়ে মাচায় তরমুজ চাষ করে সফলতা পেয়েছেন। ফলে আগামী বছরে এ  জাতের তরমুজ চাষে কৃষকদের আগ্রহ আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

>>আরও পড়ুন: মজাদার খাবার চা পাতার ভর্তা তাদের নিত্যসঙ্গী


বিজ্ঞাপন


তিনি জানান, জেলার তিনটি উপজেলায় প্রায় ৪০০ বিঘারও বেশি জমিতে এবার মাচায় তরমুজ চাষ হয়েছে। ইয়েলো গ্রিন, ব্ল্যাকবেরি, মধুমালা, জেসমিন ও তাইওয়ানের গোল্ডেন ক্রাউনসহ কয়েক জাতের তরমুজ চাষ এখানে হচ্ছে। এলাকায় তরমুজ চাষের জন্য কৃষকদের উন্নত জাতের বীজ সংগ্রহের পরামর্শ এবং বালাইনাশক ব্যবহারে ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। নতুন পদ্ধতির এ তরমুজ চাষ করে বাড়তি আয় হওয়ায় অর্থনৈতিকভাবেও স্বাবলম্বী হচ্ছেন জেলার কৃষকরা। সফল হওয়ায় এ তরমুজ চাষ নিয়ে এলাকার কৃষকের মাঝে ব্যাপক সাড়া পড়েছে।

প্রতিনিধি/এএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর