শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪, ঢাকা

ভ্যান চালিয়ে ছেলেদেরকে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন মকিম উদ্দীন

মো. জাহিদ হাসান মিলু
প্রকাশিত: ১৬ আগস্ট ২০২২, ০৮:৪৯ পিএম

শেয়ার করুন:

ভ্যান চালিয়ে ছেলেদেরকে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন মকিম উদ্দীন

নিজে পড়াশোনা করতে পারেননি বলে প্রবল আক্ষেপে শেষ সম্বল ১ বিঘা জমি বিক্রি করে দুই ছেলেকে এক সঙ্গে চীনে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াচ্ছেন ভ্যানচালক বাবা মকিম উদ্দীন। সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য তিনবেলা খেয়ে না খেয়ে ভ্যান চালিয়ে খরচ যোগান দিচ্ছেন তিনি।
 
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার দুওসুও ইউনিয়নের আরাজি সরলিয়া জোতপাড়া গ্রামের মকিম উদ্দীন ২৮ বছর ধরে পা চালিত ভ্যান চালিয়েছেন। এখন ৫ বছর ধরে ব্যাটারি চালিত ভ্যান চালাচ্ছেন। এতে আয় হওয়া টাকা প্রতিদিন অল্প অল্প খরচ করে বাকিটা জমা রেখে প্রতিমাসে সন্তানদের কাছে পাঠান।
tkg sonমকিম উদ্দীনের চার সন্তান দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। অনেক আগে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে হাবিবুর রহমান ও ছোট ছেলে আবুল হাসিম একসাথে চীনের জিয়াংসু ইউনিভার্সিটিতে মেকানিক্যাল ডিজাইন এন্ড ম্যানুফ্যাকচার অটোমেশন বিভাগে পড়াশোনা করছেন। হাজারো কষ্টে সন্তানদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ায় সমাজে এক আলাদা সম্মানের জায়গা তৈরী হয়েছে মকিম উদ্দীনের পরিবারের।

প্রতিবেশী মিজানুর রহমান বলেন, মকিম উদ্দীন সম্পর্কে আমার মামা হয়। মামা ভ্যান চালিয়ে কষ্ট করে ছেলেদের টাকা পাঠাচ্ছে। এতে আমি গর্ববোধ করি যে তিনি কষ্ট করে হলেও সন্তানের চীনের জিয়াংসু ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করাচ্ছেন।


বিজ্ঞাপন


নুরুজ্জামান বাবলু নামে এক প্রতিবেশী বলেন, মকিম উদ্দীন দিন আনে দিনে খায়। তিনি অনেক কষ্ট করে তাদের সন্তানদের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেক অভাবেও তারা সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ রাখেননি। বিষয়টি আসলে অনুপ্রাণিত হওয়ার মতো। আমরা আশা করছি তার সন্তানরা দক্ষ প্রকৌশলী হয়ে এলাকা ও দেশসেবায় নিয়োজিত থাকবেন।
tkg babaমকিম উদ্দীন ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি ৩৩ বছর ধরে ভ্যান চালাচ্ছি। ছোটবেলায় নিজে অভাবের কারণে পড়াশুনা করতে পারিনি। নিজের যত কষ্টই হোক ইচ্ছা ছিল সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার। তাই শেষ সম্বল জমি বিক্রি করে দুই ছেলেকে চীনে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনার জন্য পাঠিয়েছি। অনেক বয়স হয়েছে ভ্যান চালাতে কষ্ট হয়। তারপরও একদিনও বসে ছিলাম না। কারণ একটাই ভাবনা আসত, আয় না করলে তো সন্তানদের টাকা পাঠাতে পারব না তারা পড়তে পারবে না। আমরা স্বামী-স্ত্রী কখনো খেয়ে কখনো না খেয়ে থাকি। কাউকে বলা হয় না এ কষ্টের কথা।

মকিম উদ্দীনের স্ত্রী হুসনেআরা বেগম বলেন, ছেলে দুইটার পড়াশোনার করানোর ইতিহাস মনে হলে আমার বুকটা ফেটে যায়। এসব কথা মনে পড়লেই যখন তখন কান্না বের হয়। কখনও কখনও না খেয়ে সন্তানদের পড়াশোনার খরচ চালাই। দুই ছেলের জন্য আবাদিক জমিটুকু বিক্রি করে দিয়েছি। আমার সন্তানেরাও আট মাস ধরে মাছ, মাংসের মুখ দেখেনি। আমাকে খুশি রাখার জন্য মিথ্যা বললেও পরে আমি বুজতে পারি যে আমাকে শান্তনা দেওয়ার জন্য মিথ্যা বলছে। দেশ-বিদেশের সকলের কাছে দোয়া প্রার্থনা করছি আমার সন্তানদের স্বপ্ন যেন পূরণ হয়।
tkg sonমকিম উদ্দীনের বড় ছেলে হবিবুর রহমান বলেন, ‘আমার স্বপ্ন ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়াশোনা করার। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চীন অনেক উন্নত। এসব কথা বাবাকে বললে বাবা রাজি হয়ে যায়। আমার ছোট ভাইসহ ২০১৯ সালে ডিপ্লোমা করতে চীনে আসি। যদিও বাবার এমন স্বিদ্ধান্ত নিতে কঠিন ছিল কারণ আমাদের আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। এখানে ডিপ্লোমা ফ্রি ছিল। শুধু খাওয়ার খরচ যোগার করতে হত। আমার বাবা অনেক সময় বলত বাবা আমার কষ্ট হচ্ছে ভ্যান চালাতে আর পারছি না। আমি বাবাকে বললাম, বাবা একটু কষ্ট কর খুব শ্রীঘ্রই সু-সংবাদ দিব। মা-বাবার দোয়ায় কয়েকদিন আগে সু-খবর দিতে পেয়েছি। বিএসসিতে চীনের জিয়াংসু বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছি। তারা আমাদের ফ্রিতে পড়াশোনা করাবেন এবং প্রতি মাসে ৪০ হাজার টাকা করে দিবেন বলে জানিয়েছেন। আমি ও আমার ছোট ভাই পড়াশোনা শেষ করে বাংলাদেশে ফিরে দেশের জন্য কাজ করব ইনশাল্লাহ। আমরা আমাদের মেধা দেশের জন্য কাজে লাগাতে চাই। আমাদের খুব ইচ্ছা আমরা গবেষণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করার।

বালীয়াডাঙ্গী উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যোবায়ের হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, বিষয়টি আসলেই অনুপ্রাণিত হওয়ার মতো। ভ্যান চালিয়ে তিনি দুই ছেলেকে চীনে পড়াশোনা করান। এখান থেকে বোঝা যায় যদি মানুষের ইচ্ছা শক্তি ও পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকে তবে সফলতার দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। যদি কখনও তাদের সহযোগিতার প্রয়োজন হয় তাহলে উপজেলা প্রশাসন পাশে থাকবে।

প্রতিনিধি/এএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর