বগুড়ার ধুনট উপজেলার বেলকুচি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা ফৌজিয়া বিথী। এলাকার অসহায় মানুষের বিপদ আপদের সঙ্গী ‘বীথি আপা।’ গ্রামের দশজনকে ভাল রাখার মধ্যে নিজে ভাল থাকার আনন্দ খুঁজে পান বিথী। আর একারণেই নিজের সামর্থ্য দিয়ে অসহায় এবং বিপদগ্রস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ান তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার সময় অমানুষিক নির্যাতনের শিকার ফৌজিয়া বিথী আজ নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে নিজের মনোবল গড়ে তুলেছেন। বিবেকের তাগিদে এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সামাজিক কাজ করে আসছেন। প্রচার বিমুখ ফৌজিয়া বিথীর কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে আসে ২০২০ সালে শুরু হওয়া করোনা পরিস্থিতির সময়। সেই সময় করোনা পরিস্থিতির কারণে সারাদেশে বন্ধ ছিল সব ধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। করোনায় কর্মহীন হয়ে পড়ায় অনেক শিক্ষার্থীর বাবা মা কাজ করতে পারছিল না। সেইসব অসহায় শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বগুড়ার ধুনট উপজেলার বেলকুচি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ও মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হকের কন্যা ফৌজিয়া বিথি।
বিজ্ঞাপন
নিজের বেতনের টাকায় কেনা জামা কাপড় ও ঈদ সামগ্রী ২ শতাধিক স্কুল শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করেছেন তিনি। করোনা পরিস্থিতিতে যখন প্রত্যেকে নিজে বাঁচার চেষ্টায় ব্যাকুল, সে সময় মাঠে নেমেছেন তিনি। করোনা ভয়াবহতা নিয়ে যখন সারা দেশ আতঙ্কিত, সেই সময় মাস্ক-এর সংকট দেখা দিলে নিজ বাড়িতে, নিজের হাতে মাস্ক তৈরি করে এলাকার নিম্ন আয়ের মানুষের মাঝে মাস্ক বিতরণ করছেন তিনি। শুধু করোনাকালেই না, বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে ফৌজিয়া বিথী দাঁড়ান দীর্ঘ দিন ধরে।
>> আরও পড়ুন: ঢাকা মেইলে সংবাদ প্রকাশের পর হুইলচেয়ার পেল সেই জাফরিন
এলাকার যেখানেই নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, সেখানেই আগে হাজির হন তিনি। আর এলাকার কোনো মানুষ দিনে বা রাতে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদেরও ভরসা এই ফৌজিয়া বিথী।
নিজ উদ্যোগে সেই মানুষকে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া এবং চিকিৎসার খোঁজখবর রাখা, নিজে রান্না করে খাবার নিয়ে হাসপাতালে হাজির হওয়া যেন তার নিত্যদিনের কাজ।
স্কুল শিক্ষিকা বিথী বলেন, ‘আমার বাবা বলতেন, নিজে বাঁচার নাম জীবন নয়, সবাইকে নিয়ে বাঁচাই জীবন। বাবার এই কথা সবসময় মনে ধারণ করে চলি। বাবার দেওয়া শিক্ষা থেকে সাধ্যমতো চেষ্টা করি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। যদিও চাকরি, সংসার আর অসুস্থ সন্তান ঘরে, তারপরও মন চায় সব মানুষ ভালো থাকুক। এ কারণেই বরাবরের মতো চেষ্টা করছি কিছু করার।
বিথীর কৈশোরকাল কেটেছে নানা বাড়িতে মামা খালাদের পরম আদরে যত্নে। সবার আদরের দূরন্ত বালিকা মেয়েটি ঘুরে বেড়াতো গ্রামময়। বীথির ছুটে চলা দেখে গ্রামের সবাই দস্যুরানী বলে ডাকত। কাক ডাকা ভোর থেকে শুরু হতো তার গাছের মগডালে উঠে ফুল পাড়া, পাখির ছানা ধরা; জাম, বরই গাছে উঠে ফল পেড়ে খাওয়া। কোথায় মেলা, কোথায় খেলা সেখানে ছুটে যাওয়া। স্কুল পালিয়ে হাটুজলে নেমে মাছ ধরা, পুকুরে ডুব সাঁতার কাটা, বিলের পানিতে নেমে শাপলা তুলে আনা, বৃষ্টিরতে কাক ভেজা হয়ে ঘরে ফেরা, পুতুলের বিয়ে বিয়ে খেলা। এভাবেই প্রজাপতির মতো দস্যিপনায় করে বেড়াতো কিশোরী বিথী। এভাবেই কেটে যেত মেয়েটির ব্যস্ত দিন।
বিজ্ঞাপন
হঠাৎ অন্ধকার নেমে আসে চঞ্চলা হরিণীর মতো ছুটে চলা মেয়েটির জীবনে। ১৯৯৫ সালে বিথীর বিয়ে হয়। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তার দাম্পত্য জীবন নরকে পরিণত হয়। ‘যৌতুকের জন্য স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে নির্যাতন’ করতে থাকে। এমনকি তাকে এইচএসসি পরীক্ষায় বসতে না দেওয়ার জন্য তারা একটি ‘ঘরে তালাবদ্ধ’ করে রাখে। পরে তার পরিবারের সদস্যরা তাকে উদ্ধার করে এবং তিনি এইচএসসিতে ফার্স্ট ডিভিশন পান। পরের বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন বিথী। ‘দুর্ভাগ্যক্রমে’ তার স্বামীও একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
>> আরও পড়ুন: ওড়না আর টানবেন না—দিলেন মুচলেকা
বিথী জানান, ১৯৯৮ সালে একদিন তার স্বামী যৌতুকের জন্য খোলা ক্যাম্পাসে তাকে নির্মমভাবে মারধর করে। ওই সময় বিথী বিবাহবিচ্ছেদ করেন এবং ঘটনার এক বছর পর রাজ্জাকুল নামের একজনকে বিয়ে করেন। জীবনের এই শিক্ষা থেকে তিনি সবসময় নির্যাতিত নারীদের জন্য লড়াই করে চলেছেন।
বিথী নারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘নিজেকে নারী ভেবে পিছিয়ে থেকো না, নারীরাও সব পারে এটা নারীদের নিজেদেরই বুঝিয়ে দিতে হবে। মুখ বন্ধ করে নির্যাতন মেনে নিলে চলবে না। নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি নিজেরই অর্জন করতে হবে।
বিথীর স্বামী সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবি রাজ্জাকুল কবির বিদ্যুত বলেন, বিথীর অতীতটা খুব কষ্টের ছিল। আমি মনে করি বীথি নিজের মনবল দিয়ে যুদ্ধ করে একজন সফল নারী হিসেবে তৈরি করতে পেরেছে নিজেকে। বিথী একজন ভালো শিক্ষিকা, ভালো মা। বিথী ধুনটবাসির গর্ব। আমি বিথীর এইসব সকল সামাজিক কার্যক্রম দেখে খুব এনজয় করি।
বিথী ইতিমধ্যে করোনার সময়ে মাস্ক বিতরণ, লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে খাদ্য সহায়তা, ছাত্রছাত্রীদের মাঝে শিক্ষা সহায়তা প্রদানসহ সাহসী নারী নেত্রী হিসেবে জয়িতা পদক অর্জন করেছে।
এছাড়াও গত বছর সমাজসেবামূলক কাজে উৎসাহিত করতে বগুড়ার ধুনট উপজেলার স্কুল শিক্ষিকা ফৌজিয়া বিথীকে একটি সেলাই মেশিন ও নগদ ১০ হাজার টাকার চেক উপহার দিয়েছেন বগুড়ার জেলা প্রশাসক (ডিসি) ।
>> আরও পড়ুন: পাহাড়ের আখ ক্ষেতে জনপ্রিয় হচ্ছে সাথীফসল
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সঞ্জয় কুমার মহন্ত বলেন, ফৌজিয়া বীথি মানবিক একজন মানুষ। তার মানবিক কাজগুলি অনেক প্রশংসনীয়। আমি মনে করি ফৌজিয়া বীথি ধুনট বাসির গর্ব।
ইউএনও আরও বলেন, তিনি অনেক সময় এসে আমার কাছে অনেকের জন্য সহযোগিতাও চেয়েছেন। সাধ্যমতো আমি তাকে সহযোগিতা করেছি।
প্রতিনিধি/এএ
ঢাকা মেইলে সারাদেশের বিশেষ প্রতিবেদন পড়তে ক্লিক করুন।