মার্মারা বলে ক্রাইং, চাকমারা বলে কুচ্ছেল, ত্রিপুরা বলে ক্রুউ, বাংলায় ইক্ষু বা আখ, ইংরেজীতে সুগারক্যান (Sugarcane)। আমাদের দেশে বিভিন্ন জাতের আখ আছে। বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট বান্দরবান অফিস সূত্রে জানা যায়, চিবিয়ে খাওয়া জাতের আখ ৪ প্রকার। যেমন— বিএসআরআই আখ-৪২ (রংবিলাস), বিএসআরআই আখ-৪৭, চায়না ও সেনেগাল। তবে জেলার আখ চাষিরা রংবিলাস জাতের আখই বেশি উৎপাদন করছেন বলে জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বান্দরবানের জেলা সদর, রোয়াংছড়ি, লামা, আলিকদম— এই চারটি উপজেলায় ৬টি জাতের আখের চাষ হচ্ছে। জেলায় আখ ক্ষেতে সাথী ফসল হিসেবে বাঁধাকপি, আলু, শাক, মূলাসহ অন্যান্য চাষাবাদও হচ্ছে। ফলে চাষিরা একই ক্ষেতে একাধিকরকমের ফসল উৎপাদন করে লাভবার হতে পারছেন।
বান্দরবান সদর উপজেলার জামছড়ি ইউনিয়নের ক্রাইক্ষ্যং পাড়ানিবাসী বনবিভাগের কর্মচারী ক্যশৈ মং মার্মা (৬৫) জানান, তিনিই প্রথম ২০০৯ সালে এলাকায় রংবিলাস জাতের আখ চাষ শুরু করেছিলেন। তার দেখাদেখি করে ধীরে ধীরে এলাকায় আখ চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ বছর রংবিলাস জাতের আখ চাষ করেছেন মে মং মার্মা (৬৭)। তিনি দেড়কানি (৬০ শতক) চাষ করেছেন। বলেন, ‘ক্রাইক্ষ্যং পাড়ায় এবছর ১১ জন ইক্ষু চাষি আছেন। তিনি এবার আড়াই লাখ টাকার ইক্ষু বিক্রির আশা করছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে ইক্ষু চাষে ভালো লাভ হয় বলে জানান।
তিনি বলেন, আখ পরিপূর্ণ বয়সে ১৫-২০ ফুট লম্বা হয়। বড় বা লম্বা হলে খুঁটি দিয়ে বেঁধে রাখতে হয় যাতে হেলে না পড়ে। একটি খুঁটির দাম ৬০-৭০ টাকা, প্রতি ৪০ শতক জায়গায় প্রায় ১১-১২ হাজার আখ উৎপাদন হয়,। সেই হিসেবে প্রতি ৪০ শতক জায়গায় শুধু ২৫-৩০ হাজার টাকার খুঁটি লাগে। লাভ যেমন হয়, খরচ ও পরিচর্চাও আছে বলে জানান।
বিজ্ঞাপন
তিনি অভিযোগের সুরে বলেন, ‘গরীব ইক্ষুচাষিরা যদি ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে কৃষি ঋণ পেত, তাহলে তারা আরও লাভবান হত এবং অন্যান্যরাও এটি চাষের দিকে ঝুঁকত।
জামছড়ি এলাকার চাষি মংসিংনু মার্মা (৪৫) বলেন, ২২ বছর তামাক কোম্পানিতে চাকরি করেছি। এখন নিজের জমিতে পুরোদমে কৃষক হিসেবে কাজ করছি। গত বছর ৩ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার আখ ও বীজ বিক্রি করেছি।
এ বছর ৪০ শতক চাষ করেছেন তিনি। বলেন, ‘আরও বেশি চাষ করার ইচ্ছে থাকলেও সম্ভব হয় না। কারণ, শ্রমিকের অভাব। সময়মতো শ্রমিক পাওয়া যায় না। তাই নিজেই ইক্ষু ক্ষেতের পরিচর্চা করছি।’
এ বছরও ৩লাখ টাকার ইক্ষু বিক্রির আশা করছেন তিনি। আরও বলেন, ‘ইক্ষুর সাথে সাথী ফসল করা যায়, আগে কোনো কৃষকের ধারণা ছিল না। ইক্ষুগবেষণা কর্মকর্তাদের পরামর্শে ইক্ষুর সাথে বিভিন্ন শাক, মূলা, বাঁধাকপি, আলুসহ বিভন্ন সাথীফসল করে ইক্ষুচাষীরা লাভবান হচ্ছেন, সেজন্য এলাকায় দিন দিন ইক্ষু চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানান এই কৃষক।
একই এলাকার আরেক চাষি খ্যাই নু মং মার্মা (৪২) বলেন, রংবিলাস জাতের ইক্ষু’র রোগ-বালাই কম, ইক্ষুগবেষণা অফিস থেকে বীজ, সার, কীটনাশক ও চাষিদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদান করে ফিল্ড অফিসাররা ইক্ষু চাষীদেরকে নিয়মিত তদারকি ও পরামর্শ দেন।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইক্ষুর সঙ্গে সাথীফসল কীভাবে উৎপাদন করা যায়, গুড় কীভাবে উৎপাদন করা যায়, কৃষকদের মাঠ দিবসের প্রশিক্ষণসহ গত এক বছরে ১ হাজার ২০ জন ইক্ষু চাষিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বান্দরবানে ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে ২৭৮ হেক্টর, ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে ২৯৫ হেক্টর, ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে ৩৫৫ হেক্টর জমিতে ইক্ষু চাষ করা হয়েছে। ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে বান্দরবান ৩৫৫ হেক্টর, রাঙ্গামাটি-২৯৫ হেক্টর, খাগড়াছড়িতে ৪৪০ হেক্টর জায়গায় ইক্ষু চাষ করা হচ্ছে। ইক্ষু উৎপাদন খরচ প্রতি হেক্টরে ১ লাখ ৭৩ হাজার, লাভ হয় ৬ লাখ ৭৫ হাজার। সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতি হেক্টরে নীট আয় হয় প্রায় ৫ লাখ টাকা।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট বান্দরবান উপকেন্দ্রের কন্সালটেন্ট কৃষিবিদ ক্যছেন ঢাকা মেইলকে জানান, বান্দরবানসহ তিন পার্বত্যজেলায় দিনদিন ইক্ষুর চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে, আগামীতে ব্যাংক থেকে গরীব চাষিদেরকে কৃষিঋণ পেতে সহায়তা করা হবে। বান্দরবানসহ তিন পার্বত্য জেলার মাটি ও আবহাওয়া ইক্ষু চাষের জন্য খুবই উপযোগী এবং বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট বান্দরবান এর পক্ষ থেকে ইক্ষু চাষিদেরকে সার্বিক সহায়তা করার কারণে ইক্ষু চাষিরা যথেষ্ট লাভবান হচ্ছেন। আগামীতে আখের রস থেকে জুস তৈরির পরিকল্পনা আছে বলে জানান এই কৃষিবিদ।
প্রতিনিধি/এএ