শতাধিক বছরের পুরনো একটি মুসাফিরখানা আছে উত্তরের জেলা নওগাঁয়। যেখানে এখনও ক্লান্ত পথিকের জন্য ফ্রিতে থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। চাইলে আপনিও ফ্রিতে থাকতে এবং খেতে পারবেন এখানে। বিষয়টি শুনে অবাক লাগারই কথা। এ যুগেও কি বিনামূল্যে থাকা এবং খাওয়া সম্ভব!
অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য। ১১৪ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই মুসাফিরখানাটি জেলার পোরশা উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা মিনা বাজারের অবস্থিত। যেখানে দূর-দুরান্ত থেকে আসা ক্লান্ত মানুষ নিরাপদে নিশ্চিন্তে রাত্রিযাপন করতে পারেন। দেওয়া হয় বিনামূল্যে খাবারও।
বিজ্ঞাপন
জানা যায়, মুসাফিরখানাটি ১৯০৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন পোরশার জমিদার খাদেম মোহাম্মদ শাহ্। সেসময় অন্য এলাকা থেকে কেউ আসলে কাজ শেষে ফিরে যাওয়াটা কষ্টের ছিল। এছাড়া কোথায় থাকবে বা কী খাবে তার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এজন্য জমিদার খাদেম মোহাম্মদ পোরশায় তার মঞ্জিলের পাশেই একটা মাটির বাড়ি বানিয়ে নাম দেন ‘মুসাফিরখানা’।
স্থানীয়রা জানান, মুসাফিরখানাটি পরিচালনার জন্য জমিদার তার ৮০ বিঘা জমি দেন, যাতে মুসাফিরদের এখানে থাকা এবং খাওয়ার কোনো অসুবিধা না হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে আবার নতুন করে পাকা ভবন তৈরি করা হয়। দোতলা এই ভবনে ৫০-৬০ জন থাকতে পারেন। ১১৪ বছর পরে এসে এখনও মুসাফিরখানাটি সব সময় অতিথিদের জন্য খোলা, থাকা খাওয়ার কোনো খরচ দিতে হয় না।
ওই এলাকার প্রবীণদের ভাষ্যমতে, ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দের পর তৎকালীন বাদশা আলমগীরের আমলে ইরান থেকে হিজরত করতে বাংলাদেশের বরিশালে আসেন শাহ্ বংশের কয়েকজন লোক। এদের মধ্যে ফাজেল শাহ্, দ্বীন মোহাম্মদ শাহ্, ভাদু শাহ্, মুহিদ শাহ্, জান মোহাম্মদ শাহ্, খান মোহাম্মদ শাহ্ অন্যতম। পরবর্তীতে তারা আসেন নওগাঁর পোরশা উপজেলায়। এরপর এখানকার মাটি ও মানুষের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠে। তাদেরই বংশধর জমিদার খাদেম মোহাম্মদ শাহ।
জেলা শহর নওগাঁ থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মুসাফিরখানাটিতে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বাজারের প্রধান সড়কের সাথে লাগানো লম্বা দ্বিতল ভবন। বড় করে সাইনবোর্ড ঝোলানো রয়েছে। লেখা— ‘পোরশা মোসাফির খানা’।
‘মুসাফিরখানার নামে ৮০ বিঘা জমি আছে। এই আয় থেকে খরচ করা হয়। এছাড়া স্থানীয়রাও অর্থ দিয় সহযোগিতা করে থাকেন। এখানে থাকা ও খাওয়া একদম ফ্রি। দু’বেলা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। যদি কেউ দুপুরে খেতে চান সকাল ৯টার মধ্যে এবং রাতে খেতে চাইলে বিকেল ৪টার মধ্যে বলতে হয়।’
ভবনটিতে রয়েছে বিভিন্ন নকশায় শিল্পের সমারোহ। মেঝেতে গালিচা বিছানো। সব মিলিয়ে প্রায় ১৬টি ঘর রয়েছে। রয়েছে খাট, তোষক, বালিশ ও ফ্যান। উত্তরপাশে রয়েছে শান বাঁধানো পুকুর ঘাট। ক্লান্ত পথিক সেখানে গোসল ও ওযু করে ক্লান্তি দূর করতে পারবেন।
বিজ্ঞাপন
স্থানীয়রা বলেন, বর্তমানে রাস্তাঘাট পাকাকরণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা আগের চেয়ে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। ফলে আগের মতো আর সমস্যায় পড়তে হয় না পথিকদের। তারপরও মুসাফিরখানাটিতে অতিথিদের আনাগোনা সারাবছরই রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, একজন মুসাফির সর্বোচ্চ তিন থাকতে পারবেন এখানে। পাশাপাশি দুপুর ও রাতে বিনামূল্যে খাবারের সুবিধা পাবেন। তবে খাবারের জন্য কর্তৃপক্ষকে আগেই জানাতে হবে।
মুসাফিরখানাটির সেবক মিজানুর রহমান বলেন, ‘কেউ দু’দিনের জন্য আবার কেউ তিন দিনের জন্য এখানে থাকেন। যারা থাকেন তাদের জন্য বিছানা প্রস্তুত করা হয়। এছাড়া পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়গুলো দেখভাল করতে হয়। প্রতিদিনই গড়ে ৪-৫ জন আসেন। অনেক দূরদূরান্ত থেকে মুসাফিররা আসেন এখানে।
১৯৯৬ সাল থেকে এখানকার সার্বিক দায়িত্বে আছেন মো. সিরাজুল ইসলাম নামের একজন। তিনি বলেন, ‘মুসাফিরখানার নামে ৮০ বিঘা জমি আছে। এই আয় থেকে খরচ করা হয়। এছাড়া স্থানীয়রাও অর্থ দিয় সহযোগিতা করে থাকেন। এখানে থাকা ও খাওয়া একদম ফ্রি। দু’বেলা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। যদি কেউ দুপুরে খেতে চান সকাল ৯টার মধ্যে এবং রাতে খেতে চাইলে বিকেল ৪টার মধ্যে বলতে হয়।’
‘প্রতি বুধবার দুপুরে এখানে স্থানীয় ও অসহায়দের একবেলা খাবার দেওয়া হয়। যেখানে প্রায় ৪০-৫০ জন খাবার খেয়ে থাকেন। সবচেয়ে বেশি মানুষ হয় রমজানে মাসে।’
পোরশা মুসাফিরখানার সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল ইসলাম শাহ বলেন, ‘এটি যখন প্রতিষ্ঠান করা হয়েছিল, সে সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ ছিল। এলাকার বাইরের কেউ আসলে কাজ শেষ করে ফিরে যাওয়াটা তার জন্য অত্যান্ত কষ্টের ছিল। এছাড়া কোথায় থাকবে বা কী খাবে তার কোনো ব্যবস্থা ছিল না।
তিনি বলেন, মুসাফিরখানার নিজস্ব সম্পদ রয়েছে যা দিয়ে এর কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এছাড়া এলাকাবাসীও বিভিন্নভাবে এখানে সহযোগীতা করে থাকেন।
প্রতিনিধি/এএ