মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৫, ঢাকা

এক নদীতে গোসল করে দুই দেশের নাগরিক 

জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৭:০০ পিএম

শেয়ার করুন:

loading/img
মহানন্দা নদী | ছবি : ঢাকা মেইল

বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী মহানন্দা। প্রায় ৩৬০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য মহানন্দা নদীর উৎপত্তিস্থল হিমালয় পর্বতের ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দার্জিলিং জেলার অংশে। দার্জিলিং থেকে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে উত্তর দিনাজপুর দিয়ে মালদা জেলা হয়ে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ভোলাহাট উপজেলা দিয়ে প্রবেশ করেছে এই নদী।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটে মহানন্দা নদীর ওপারে ভারতের মালদা জেলার আইহো থানার শুকনগর এলাকার লোকজন। নদীর উল্টো দিকে এপারে ভোলাহাটের গোহালবাড়ী, গীলাবাড়ি, আলীসাহপুর, বজরাটেক, মুন্সীগঞ্জ এলাকার লোকজন গোসল করছে। এখানে মহানন্দা নদীই আলাদা করেছে দুটি দেশকে। এমনকি দুই দেশের সীমানা চিহ্নিত করেছে মহানন্দা নদী। কোথাও নদীর মাঝ বরাবর, আবার কোথাও নদীর কিনারা দিয়ে দুই দেশের সীমান্তের শূন্য রেখা। 


বিজ্ঞাপন


ভোলাহাটের স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘ দিন থেকে বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের লোকজন গোসল করে মহানন্দা নদীতে। তবে বাংলাদেশিরাই সবচেয়ে বেশি মানুষ গোসল করে। কাপড় চোপড় পরিষ্কার করার কাজেও নদীতে যায় নদীপাড়ের সিংহভাগ বাসিন্দা। অন্যদিকে, নদী পার হয়ে ভারতীয় সীমানার দিকে কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে আসতে হয় ভারতীয় নাগরিকের। তবে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফ তাদের দেশের নাগরিকদের তারেরবেড়া পেরিয়ে শূন্য রেখায় যাওয়ার অনুমতি দেয়। কারণ তারেরবেড়া পেরিয়ে নদীর ওপারে ফসলী জমি রয়েছে সেদেশের নাগরিকদের। 

river

সীমান্ত আইন অনুযায়ী, দুই দেশের নাগরিকদের শূন্য রেখায় যাওয়ার প্রতি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশ বলছে, নিষেধাজ্ঞা থাকা স্বত্ত্বেও দুই দেশের নাগরিকরা দীর্ঘদিন ধরে মহানন্দা নদীতে গোসল করে। বিজিবির পক্ষ থেকে বাংলাদেশি নাগরিকদের নিয়মিত এবিষয়ে সতর্ক করা হয়। তবে তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে শূন্য রেখায় থাকা নদীতে গিয়ে গোসল করে বলছে স্থানীয় বিজিবি ব্যাটলিয়নের অধিনায়ক। 

স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দা সাইদুর রহমান (৬০) বলেন, নদীই এখানে আলাদা করেছে দুইটি দেশকে। কিন্তু দুই দেশের নাগরিক হলেও আমাদের মাঝে সম্প্রীতির বন্ধন মজবুত রয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে একই নদীতে বাংলাদেশের ও ভারতের মানুষ গোসল করি। আমরা আমাদের পাড়ে, তারা তাদের পাড়ে গোসল করে। এতে আজ পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয়নি। তারা তাদের মতো, আমরা আমাদের মতো গোসল করি, কাপড় ধোলায় করি।


বিজ্ঞাপন


স্থানীয় কৃষক আব্দুর রাকিব জানান, এখানে সীমান্তে বিজিবি বা বিএসএফ-এর দিক থেকে কোনো জটিলতা নেই। তাই দুই দেশের বাসিন্দারা একটি নদীতে গোসল করতে পারে। তবে নদীতে গোসল করা নাগরিকদের মধ্যে বাংলাদেশিরাই বেশি। কারণ ভারতের দিকে নদী পার হয়েই কাঁটাতারের বেড়া। ভারতীয়দের গোসল করা মানুষের প্রায় সবাই কৃষক। বিএসএফ-এর বিশেষ অনুমতি নিয়ে এসে তারা নদীপাড়ে ফসলের জমিতে কাজ করে। কাজের মাঝে দুপুরে মহানন্দা নদীতে গোসল করে তারা।

river

গৃহিণী মাতোয়ারা বেগম জানান, আমরা প্রতিদিন নদীতেই গোসল করি। কাপড় পরিষ্কার করি। কেউ কখনও বাধা দেয় না। এমনকি নদী থেকেই দেখা যায় টাওয়ারে বসে থাকা বিএসএফ সৈনিকদের। ওপারে বিএসএফ, এপারে বিজিবি ক্যাম্প, সবাই নিজেদের দায়িত্ব পালন করছে। গত ১০ বছর ধরে এখানে গোসল করি। একই সময়ে ওপারে মাত্র কয়েকগজ দূরে ভারতীয় কৃষকেরা গোসল করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয়নি। 

কথা হয় নদীর ওপারে গোসল করা এক ভারতীয় কৃষক উত্তম ঘোঁষের সাথে। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, আমরা তারেরবেড়া পেরিয়ে ফসল চাষাবাদ করতে আসি। এসে দুপুর হলে নদীতেই গোসল করি। তবে বাংলাদেশের দিকে কোনো বিধিনিষেধ বা কাঁটাতারের বেড়া না থাকায় প্রচুর মানুষ নদীতে গোসল করে। তারা তাদের মতো, আমরা আমাদের মতো গোসল শেষে কাজ করে বাসায় ফিরে যায়। 

স্থানীয় ইউপি সদস্য নাজমুল শাহ ইয়ারুল জানান, এখানে বিজিবি বা বিএসএফের কোনো হয়রানি নেই। এননকি আমিও এ নদীতে গোসল করি। সবাই নিজেদের মতো করে। নদীর পানি ব্যবহার করে কৃষিকাজ করে, গোসল করে, কাপড়া কাঁচার কাজে ব্যবহার করে। এমনকি দুই দেশের জেলেরা নৌকায় পতাকা উড়িয়ে নদীতে মাছ ধরে। দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি এটা আমাদের।

river

ভোলাহাট থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাহবুবুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের থানা ঘেঁষেই সীমান্ত। নদীতে দুই দেশের মানুষই গোসল করে। তবে এনিয়ে কোনো ঝামেলা বা অপরাধ সংঘটিত হওয়ার ঘটনা ঘটে না।

তবে মহানন্দা নদীতে দুই দেশের শূন্য রেখায় অবস্থান করাকে অপরাধ বলছেন ৫৯ বিজিবি ব্যাটলিয়নের অধিনায়ক আমির হোসেন মোল্লা। ঢাকা মেইলকে তিনি জানান, বিজিবি সদস্যরা সীমান্তের বাসিন্দাদের শূন্য রেখায় না যাওয়ার জন্য সতর্ক করে। তবে বিজিবি চোখ ফাঁকি দিয়ে অনেকেই শূন্য রেখায় থাকা নদীতে গোসল করে। 

বিজিবি অধিনায়ক আরও জানান, শূন্য রেখায় দুই দেশের নাগরিকদের অবস্থানের ফলে সীমান্তে অস্ত্র-মাদক চোরাচালান, অবৈধ অনুপ্রবেশসহ বিভিন্ন অপরাধের সম্ভাবনা বাড়ে। এবিষয়ে বিজিবি সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। কোনোভাবেই দুই দেশের নাগরিকদের শূন্য রেখায় যেতে দেয়া হবে না। 

উল্লেখ্য, ভারতের মালদা হয়ে বাংলাদেশের ভোলাহাট দিয়ে প্রবেশ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর, গোমস্তাপুর হয়ে জেলা শহর দিয়ে অতিক্রম করেছে মহানন্দা নদী। পরে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে গিয়ে মহানন্দা নদী পদ্মা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। মহানন্দা নদীর পাঁচটি উপনদী রয়েছে। সেগুলো হলো— পূনর্ভবা, নাগর, টাংগন, কুলিক ও কালিন্দী। পূনর্ভবা ছাড়া সবগুলোই রয়েছে ভারতে। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত মহানন্দা নদীর অংশটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৬ কিলোমিটার।

এইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন