শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

বাপ-দাদার পেশা আজও ধরে রেখেছেন পাকুড়িহাটার বাসিন্দারা

পারভীন লুনা
প্রকাশিত: ২৩ জুলাই ২০২২, ০৭:০৪ পিএম

শেয়ার করুন:

বাপ-দাদার পেশা আজও ধরে রেখেছেন পাকুড়িহাটার বাসিন্দারা
ছবি: ঢাকা মেইল

গাঁয়ের নাম পাকুড়িহাটা। বগুড়ার ধুনট উপজেলার একটি নিভৃত পল্লী গাঁ। এ গাঁয়ে ঢুকলে যে দৃশ্য চোখে পড়ে—ঠুকঠাক শব্দ চলছে অবিরাম। যেনো সংগীতের কোনো তরঙ্গ। রাস্তার ধারে, বাড়ির পাশে ফাঁকা জায়গায়, পুকুরের পারে বসে ব্যস্ত সময় পার করছে শিশু থেকে নারী-পুরুষ। কেউ বাঁশ কাটছেন, কেউ বাঁশ চাঁচছেন, কেউবা বাঁশের বেতি তুলছেন। নারীরা সংসারের কাজের ফাঁকে এ কাজ করেন। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে তাদের এ কর্মযজ্ঞ। এভাবে এক সময় দক্ষ হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় বাঁশ নিত্য ব্যবহার্য ও আকর্ষণীয় পণ্যে রূপ নেয়।

পরিবারের অর্থনৈতিক চাঁকা সচল রাখতে বাঁশের তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন পাকুড়িহাট গ্রামের দুই হাজার পরিবার। বাঁশ শিল্পের তারা নিপুণ কারিগর। বাপ-দাদার পেশা টিকিয়ে রাখছেন তারা। এছাড়া তারা আর অন্য কোনো কাজ জানেন না। বংশগতভাবে তারা এ কাজ শিখে এসে নিজেদের অর্থ খাটিয়ে বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে। এই পরিবারগুলোর কৃষিজমিও নেই। কোনো ব্যাংক কিংবা এনজিও তাদেরকে অর্থ ঋণ দেয় না। ফলে নিজেদের কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে কোনোরকমে তারা এ পেশায় টিকে আছে। 


বিজ্ঞাপন


কথা হয় শাহাজাহান নামের এক কারিগরের সঙ্গে। তিনি জানালেন, এই বাঁশশিল্পের কাজ করতেন তার দাদা। তারপর তার বাবা, বংশপরম্পরায় এখন করেন তিনি। এরপর হয়তো তার ছেলে-মেয়েরা করবে। 

অকপটে জানালেন, এ কাজ ছাড়া আর কোনো কাজ তারা জানেন না। 

শাহজাহান বলেন, আগে এই এলাকায় প্রচুর বাঁশ ঝাড় ছিলো। সেখান থেকে এই এলাকার মানুষ এই পেশায় জড়িত।
bamoboo boguraকত বছর ধরে এ পেশায় আছেন তারা, ঠিক-ঠাক উত্তর দিতে পারেন নি। তবে, অনুমান করছেন, দুই শ বছর ধরে এ কাজ করছে তারা।   
 
তিনি বলেন, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ এই দুই মাস তাদের প্রচুর কাজের চাপ থাকে। এই দুই মাসই বাঁশশিল্পের উপযুক্ত সময়। 

শাহজাহান আরও জানালেন, আগে বাঁশের দাম কম ছিল, তাই তাদের তৈরি জিনিস বিক্রি করে ভালো লাভ হতো। এখন বাঁশ কিনতে হয় বেশি দাম দিয়ে। আবার শ্রমিকের মজুরি বেশি হওয়ায় তারা ভালো লাভ করতে পারছেন না। আগে একটা বাঁশের দাম ছিল ৭০ থেকে ৯০ টাকা, এখন সেই বাঁশ কিনতে হয় ১০০ থেকে ১৩০ টাকা।


বিজ্ঞাপন


শাহজাহানের মতো কথা হয় আরও কয়েকজন কারিগরের সঙ্গে। তাদের কণ্ঠে হতাশার ছাপ পাওয়া গেল। গত কয়েক বছরে প্রযুক্তির ব্যবহার ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় দিন দিন বাঁশ শিল্পের ব্যবহার হারিয়ে যেতে বসেছে। এ ব্যবসায় মন্দাভাব থাকায় বাঁশ শিল্পের সঙ্গে জড়িত এই পরিবারগুলোতে চলছে দুর্দিন। দিন দিন জৌলুস হারিয়েছে এই শিল্প বিদ্যমান পরিস্থিতিতেও দৃঢ় মনোবল নিয়ে বাঁশের পণ্য তৈরি ও তা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন তারা।

পাকুড়িহাটা ছাড়াও উপজেলার নলডাঙ্গা, আনন্দগঞ্জ, কান্দুনিয়া, দাঁড়াকাটা, রুদ্রবাড়িয়া, সোনাহাটা, বেলকুচি ও বাঁশহাটাসহ প্রায় ২০ গ্রামের মানুষের জীবিকার একমাত্র পথ বাঁশের সামগ্রী তৈরি করা। বাঁশ দিয়ে শুধু চাটাই নয়। এখানে তৈরি হয় খলপা, তালাই, ডোল, খালই, হোচা, বিছন বা হাত পাখা, খাচি বা টোপা আরও কিছু পণ্য।
bamoboo boguraবাঁশের তৈরি এসব সামগ্রী জেলার বিভিন্ন উপজেলাসহ জয়পুরহাট, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, টাঙ্গাইলসহ আশপাশের জেলা শহরের ব্যবসায়ীরা কিনে স্থানীয় বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি করেন।

উপজেলার কান্দুনিয়া গ্রামের বাঁশ শিল্পের কারিগর গোলাপি জানালেন, সারাদিন সংসারের অন্য কাজের পাশাপাশি বাঁশ দিয়ে বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করেন। এতে দৈনিক তার প্রায় দেড় শ থেকে দুই শ টাকা আয় হয়।

গোলাপির স্বামী হারেজ জানান, সংসারে গৃহস্থালী কাজের ফাঁকে বাঁশের পণ্য তৈরি করে যে আয় করে, তা সংসারের কাজে লাগে। তার বাড়তি আয় সংসারের ছোটখাট কাজে খরচ করা হয়। 

গোলাপি বলেন, একটা চাটায় তৈরি করতে তার দুই দিন লাগে। সংসারের কাজ যেদিন কম থাকে, সেদিন একদিনেও শেষ করতে পারেন চাটায় তৈরি করতে। 
bambooযদু মিয়া নামের এক পাইকার জানান, তার বাড়ি বগুড়ার সদরে। তিনি এই সব গ্রাম থেকে পাইকারি দরে এইসব পন্য কিনে নিয়ে গিয়ে বগুড়া শহরের পাটিপট্টিতে বিক্রি করেন। আগে প্রচুর বাঁশের চাটায়ের চাহিদা থাকলেও বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় চাহিদা হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন স্টিল আর প্লাস্টিকের চাহিদা বেশি বলে তার ব্যবস্থা ও মন্দা যাচ্ছে। 

আমজাদ নামের এক কারিগর জানান, বাঁশের তৈরি এসব সামগ্রী জেলার বিভিন্ন উপজেলাসহ আশ-পাশের জেলাতেও যায়। জয়পুরহাট, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, টাঙ্গাইলসহ আশপাশের ব্যবসায়ীরা কিনে নিজ এলাকার বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি করেন। বাঁশের পণ্যের মধ্যে বাজারে চাটাই বিক্রি হয় প্রতি পিস ১৫০-২০০ টাকায়। ঘরের সিলিং প্রতি স্কয়ার ফিট ৩০-৪০ টাকায়। ধান রাখার ডোল বিক্রি হয় আকার ভেদে চার শ টাকা থেকে বারোশ’ টাকা পর্যন্ত। হোচা বিক্রি হয় ১২০ টাকা, ডালি ফলি এইসব বিক্রি হয় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা।

প্রতিনিধি/এইচই/এএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর