বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

উত্তরবঙ্গে সর্বশেষ ঐতিহাসিক জনসভা

দেশ বাঁচাতে-আ.লীগ পতনে ছোট বড় সব দল নিয়ে বসতে চেয়েছিলেন খালেদা জিয়া

আমানুল্লাহ আমান, রাজশাহী
প্রকাশিত: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:৪৫ এএম

শেয়ার করুন:

দেশ বাঁচাতে-আ.লীগ পতনে ছোট বড় সব দল নিয়ে বসতে চেয়েছিলেন খালেদা জিয়া

২০১৩ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর উত্তরবঙ্গে সর্বশেষ এবং সর্ববৃহৎ জনসভায় এসেছিলেন দেশের তিন বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। প্রায় ২০ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদরাসা মাঠে তিনি বক্তব্য দিয়েছিলেন। সেদিনই দেশ বাঁচাতে ও স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের পতন ঘটানোর ডাক দিয়েছিলেন তিনি। সেজন্য বসতে চেয়েছিলেন ছোট বড় সব দলের সঙ্গে।

হাসিনা সরকারের কাছে কেয়ারটেকার সরকারের দাবি জানিয়ে ওইদিন বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করা বন্ধ করতে হবে। এখন আপনারা সংবিধানের দোহাই দেন, তখন তো কেয়ারকার সরকার সংবিধানে ছিল না, তাহলে কেন দাবি করেছিলেন? শুধু দাবি করেই ক্ষান্ত হননি, আপনারা পারলামেন্টকে পর্যন্ত রিজাইন করেছিলেন। এজন্য অনেক কষ্ট করতে হয়েছে দেশে, ১৭৩ দিন হরতাল করেছিলেন, বহু মানুষ হত্যা করেছিলেন, এই নেত্রীর নির্দেশে গান পাউডার ঢেলে জীবন্ত মানুষকে হত্যা করেছিলেন বাস জ্বালিয়ে। এই সবই করেছিলেন, ভুলে গেছেন? কীসের জন্য? এই কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে। আমরা কেয়ারটেকার সরকার দিয়েছিলাম, এতে কোনো লজ্জা নাই।


বিজ্ঞাপন


খালেদা জিয়া বলেন, আমাদের বিশ্বাস ছিল, জনগণের কাছে আমরা যেতে পারবো, ভোট চাইতে পারবো, আমরা কোনো অন্যায় করি নাই। আমরা গিয়েছি এবং ভোট চেয়েছি। আপনারা সেই সময়ও কিন্তু ক্ষমতায় গিয়েছিলেন, সেখানে আপনারা ওই জাতীয় পার্টি ওই জামাত ইসলামীর সমর্থন নিয়েই সরকার গঠন করেছিলেন। এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা কখনো পান নাই আপনারা। এই হলো আপনাদের মুরোদ। কাজেই মানুষ জানে আপনারা কতদূর যেতে পারেন।

সংবিধান সংশোধন নিয়ে হাসিনার উদ্দেশ্যে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, আপনারা সংবিধান সশোধন করেছেন এমনভাবে, যাতে আপনারা চিরস্থায়ীভাবে ক্ষমতায় থাকতে পারেন। সেভাবে সংবিধান সংশোধন করেছেন, কোর্টের দেহাই দিয়ে, বাকশাল করেছিলেন, আবার আরেক বাকশাল তৈরি করলেন আপনারা। কাজেই আমরা বলছি, সেটা হবে না।

হাসিনার পদত্যাগের জোর দাবি জানিয়ে দেশের প্রথম নারী এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোনোভাবেই হাসিনার অধীনে নির্বাচন হতে পারে না। এরজন্য আমরা বলছি, হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে। নিরপেক্ষ সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। আমি মনে করি, পারলামেন্টে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের বিল নিয়ে আসুন।

হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ব্যাপক আন্দোলন হবে। কেন? সংবিধান হলো মানুষের জন্য দেশের জন্য, সংবিধান কোনো কুরআন বাইবেল নয় যে, ওখান থেকে কোনোকিছু পরিবর্তন করা যাবে না, সেজন্য বলতে চাই, সংবিধান পরিবর্তন করা যায়, এ দায়িত্ব আপনাদের। আপনাদের পরিবর্তন আনতে হবে। আর না হলে তার পরিপ্রেক্ষিতে যা হওয়ার তাই হবে। এখনো সম্মান পাচ্ছেন যতটুকু, ক্ষমতায় আছেন, তারপরে সেই সুযোগটুকু হারিয়ে যাবে, তখন হয়ত কোনো জায়গায় আশ্রয় পাবেন না, এবং পালাবার পথগুলোও সব বন্ধ হয়ে যাবে।এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।


বিজ্ঞাপন


আওয়ামী লীগের ফিরিস্তি তুলে ধরে রাজশাহীর ওই জনসভায় তিনি বলেন, কেন এই সরকার ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করতে চায়? কারণ আছে অনেকগুলি। কারণ এই ৫ বছরে ব্যাপক দুর্নীতি করেছে, কী আমি ঠিক বলছি? ব্যাপক দুর্নীতি করেছে, প্রথম হলো কুইক রেন্টার পাওয়ার প্ল্যান্ট। করে বহু টাকা পকেটে পুরেছে, কিন্তু মানুষ বিদ্যুৎ পায় না। ব্যাংক শূন্য হয়ে গেছে, ক্ষতিপূরণে লাগবে ৩০৯ বছর। ব্যাংক শূন্য হলো কোথা থেকে? আওয়ামী লীগ ব্যাংকের টাকা লুটেপুটে নিয়ে গেছে। আপনারা ভ্যাট ট্যাক্স দেবেন আর তারা লুটেপুটে খাবে, এটা কি মানা যায়? মানা যায় না।

সাংবাদিক নির্যাতন ও হত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। বলেন, এই সরকার কথায় কথায় আইন করে। এই সাংবাদিক ভাইয়েরা তারা দিনরাত পরিশ্রম করেন, ভাল ছবি নেওয়ার জন্য আপনারা কি করছেন আপনাদের কি অবস্থা আমরা কি বলছি পত্রিকায় লেখবে সেজন্য। কিন্তু সাংবাদিক নির্যাতন করা হচ্ছে। সাংবাদিকদের হত্যা করা হয়েছে। এই সরকারের আমলে প্রায় ১৮ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে।

সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার কারণ তুলে ধরেন খালেদা জিয়া। ওইদিন তিনি বলেছিলেন, সাগর-রুনির ঘটনা আপনারা পড়েন নাই? পড়েছেন। সাগর-রুনি কেন হত্যা হলো? কারণ- সাগর রুনি এই সরকারের (হাসিনা) দুর্নীতি, বিদ্যুতের দুর্নীতি, ট্যাক্সের দুর্নীতি ধরে ফেলেছিল, সেটা ক্যাসেটভুক্ত করেছিল, এবং সেটা তার ইচ্ছা ছিল সেটা প্রচার করতে, দেশে না পারলেও বাইরে করবে। সেজন্য এক রাতে যখন সরকার জানতে পারলো, তখন রাতের মধ্যে সাগর-রুনিকে হত্যা করে ফেলা হলো এবং সেখানে তার বাড়ি থেকে কোনো জিনিস  চুরি হয় নাই, শুধুমাত্র একটা ল্যাপটপ চুরি হয়ে গেছিল, আর সিডিটা চুরি হয়েছিল। কারণ সেটার মধ্যেই ছিল সব গোপন তথ্য। যার জন্য সাগর-রুনিকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে এ চুরি ঢাকার চেষ্টা করেছে।

হাসিনার রক্তপিপাসা নিয়ে কঠোর প্রতিবাদ জোনিয়ে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, যতই অন্যায় করেন, অন্যায় চাপা থাকে না। অন্যায় তা বের হয়েই যায় এবং এই তথ্য কোনো না কোনোভাবে আছে। এই সরকার যেদিন থেকে ক্ষমতায় এসেছে সেদিন থেকে এই সরকারের হাতে শুধু রক্ত, রক্ত আর রক্ত। এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে পারলামেন্ট শুরু হয়েছে ২৫শে জানুয়ারি ২০০৯, তারপর থেকেই তাদের হাতে রক্ত। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিডিআরের এতগুলা অফিসারকে হত্যা করলো। ঠিক বলি নাই?

পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিয়ে খালেদা জিয়া ওইদিন বলেন, ৫৭ জন অফিসারকে হত্যা করা হলো। কিন্তু কেন? সরকার কোথায় ছিল সেদিন? সেদিন কি দেশে কোনো সরকার ছিল না? ছিল, সেদিন তাদের নির্দেশেই করা হয়েছিল, তারা নীরব ছিল। প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহ দমনের জন্য কোনো ব্যবস্থায় নেই নাই। র‌্যাব প্রস্তুত হয়েছিল, সেনাবাহিনী প্রস্তুত ছিল, তাদেরকে যদি ভেতরে পাঠিয়ে দেওয়া হত, আধা ঘণ্টার মধ্যে এই বিদ্রোহ দমন করা সম্ভব হত, সমস্ত বিদ্রোহীদের ধরা যেত এবং অফিসারদের জান বাঁচানো যেত। কিন্তু সেটা করে নাই। উল্টো বরং যারা বিদ্রোহ করেছে, তাদেরকে প্রধানমন্ত্রী তার বাসভবন কাম অফিসে ডেকে নিয়ে যায়ে শেরাটন থেকে নাস্তা এনে নাস্তা খাইয়েছে তাদেরকে আদর আপ্যায়ন করেছে, যাতে তারা কিছু বের না হয়। এমনকি এই বিদ্রোহ যারা করেছে, তাদেরকে যাওয়ার জন্য পথ পরিষ্কার করে দিয়েছে, ওদের এক এমপি মাইকিং করে রাস্তা খালি করে দিতে বলেছে, এলাকা খালি করে দিতে বলেছে। যাতে ওই খুনিরা সুন্দরভোবে বেরিয়ে যেতে পারে। তাদের কেউ ধরতে না পারে।

রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামী নেতাকর্মী ও আলেম-ওলামাদের ওপর আওয়ামী লীগের হত্যাযজ্ঞ নিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে খালেদা জিয়া বলেন, আমরা একটি কথা বলব, ওই হেফাজতে ইসলাম। ওই ব্লগাররা যেভাবে আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর প্রতি কটূক্তি করেছিল। সেটির প্রতিবাদে হেফাজতের নেতাকর্মীরা অনুমতি নিয়েই এসেছিল, শান্তিপূর্ণভাবে এসেছিল অবস্থান করছিল বক্তব্য দিচ্ছিল, তারা তাদের আমিরের জন্য অপেক্ষা করেছিল। তারা চলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সরকার ভয়ে ভীত হয়ে আপনারা দেখলেন তারা রাতে অবস্থান করলো। তারা ছিল শান্তিপূর্ণ, কোনো অস্ত্র ছিল না। বিনা অস্ত্রধারী লোকদের, কেন অত্যাচার, কেন গুলি চললো? তাদের কাছে জায়নামাজ ও তসবি ছিল। বাহিনী বলল, নিরীহ লোকদের বলল বের করে দিতে এসেছে। যদি বের কেরে দিতেই আসেন তাহলে কেন মাইকিং করলেন না? কেন লাইট অফ করলেন? কেন ইসলামিক টিভি বন্ধ করলেন, কেন দিগন্ত টিভি বন্ধ করলেন? তার জবাব আপানাদেরকে দিতেই হবে। এবং বহু আলেমকে ওখানে হতাা করেছিল সেখানে। এই সরকার প্রতি পদে পদে অপরাধ করেছে, অন্যায় করেছে, দুর্নীতি করেছে। এই অন্যায়, দুর্নীতি, জুলুম এর শাস্তি তো তাদের ভোগ করতেই হবে।

এরপর রাজশাহীর ওই জনসভায় শান্তির বার্তা দেন খালেদা জিয়া। বলেন, কিন্তু আমরা তারপরও বলেছি, আমরা কোনো প্রতিশোধ বা কোনো প্রতিহিংসার রাজনীতি করি না। প্রতিশোধ কারও উপরে নিতে চাই না। শান্তিপূর্ণভাবে যাতে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকে, আপনারা যেভাবে বিভক্ত করে দিয়েছেন জাতিকে, বিভক্ত নয়, আমরা চাই সকলকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে। আমরা ১৮ দল এখানে আছি, আরও কয়েকটা দল বাইরে আছে, কিন্তু তাদেরও দাবি একটাই,  আমরা নির্বাচন চাই, আর সেটা নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে হবে।

আহবান জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, আসুন, এখন আমাদের দূরে থাকার সময় নয়, এখন দেশটাকে বাঁচাবার জন্য আমরা একসঙ্গে হই। এক জায়গায় বসি। কে বড় কে ছোট দল, সেটা দেখার আপনার সময় নাই। কে বড় নেতা কে ছোট নেতা দেখারও আমাদের সময় নাই। কে ডানে কে বামে কে সামনে কে পেছনে সেটা দেখারও সময় নাই। সময় শুধু একটাই যে, দেশকে রক্ষা করতে হবে। আওয়ামী লীগকে বিদায় দিতে হবে। একটা সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে হবে। আসেন এখন দেশ রক্ষার জন্য দরকার হলে সবাই এক জায়গায় একসঙ্গে দাঁড়াবো, বসবো, কেমন করে গুলি চালায়, কত গুলি চালায়, আমরা দেখি। একমাত্র পথ হলো এখন এই সরকারকে সরানো এবং দেশকে রক্ষা করা।

প্রতিনিধি/টিবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর