শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

সরিষাবাড়ীতে বর্ণাঢ্য আয়োজনে সহজপাঠ ফাউন্ডেশনের পৌষ উৎসব অনুষ্ঠিত

উপজেলা প্রতিনিধি, সরিষাবাড়ী (জামালপুর)
প্রকাশিত: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:১৬ এএম

শেয়ার করুন:

সরিষাবাড়ীতে বর্ণাঢ্য আয়োজনে সহজপাঠ ফাউন্ডেশনের পৌষ উৎসব অনুষ্ঠিত
সহজপাঠ ফাউন্ডেশনের পৌষ উৎসব অনুষ্ঠিত

জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার হাসড়া মাজালিয়া গ্রামে উদযাপিত হলো ‘সহজপাঠ পৌষ উৎসব ১৪৩২’।

শুক্রবার (২৬ ডিসেম্বর ২০২৫) দিনব্যাপী নানামুখী আয়োজনে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।


বিজ্ঞাপন


সহজপাঠ ফাউন্ডেশনের আয়োজনে এটি ছিল উৎসবের দ্বিতীয় আসর। গ্রামীণ ঐতিহ্য রক্ষা, মেধা অন্বেষণ এবং তরুণ প্রজন্মকে পাঠাভ্যাসে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে আয়োজিত এই উৎসবটি স্থানীয় শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়।

উৎসবের সূচনা হয় শীতের সকাল ৭টায় ঐতিহ্যবাহী ‘রস উৎসব’-এর মাধ্যমে। খেজুরের কাঁচা রস আর গ্রামীণ আমেজে দিনটির শুরু হয়। এই উৎসবে অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে টাটকা খেজুরের রস পান করেন আতিকুর রহমান সবুজ। তিনি বলেন, শীতের সকালে খেজুরের রসের স্বাদ বাঙালির আদি ঐতিহ্য। আধুনিকতার চাপে আমরা এসব ভুলতে বসেছি। সহজপাঠ ফাউন্ডেশন এই আয়োজন করে আমাদের আবার শিকড়ে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। এমন উৎসবে আসতে পেরে আমি আনন্দিত।

cfcecd95-3bfe-49f0-b1e4-6b2439fbf7c3

দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে একটি র‍্যালি বের করা হয়। র‍্যালিটি গ্রামের প্রধান প্রধান পথ প্রদক্ষিণ করে উৎসব প্রাঙ্গণে এসে শেষ হয়। এতে হাতে লেখা প্লেকার্ড এবং উৎসবের আমেজ লক্ষ্য করা যায়।


বিজ্ঞাপন


বিকেলে শুরু হয় জমজমাট বিতর্ক প্রতিযোগিতা। এতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বয়ড়া ইসরাইল আহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয় বনাম রুদ্র বয়ড়া উচ্চ বিদ্যালয়। যুক্তির লড়াইয়ে দর্শক-শ্রোতারা মুগ্ধ হন। প্রতিযোগিতা শেষে চ্যাম্পিয়ন দল, রানার্সআপ এবং শ্রেষ্ঠ বিতার্কিকের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেওয়া হয়।

এরপর শুরু হয় আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণী। ‘সহজপাঠ কুইজ ফেস্ট ২০২৫’-এ সরিষাবাড়ীর বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয় ও মাদরাসার শিক্ষার্থীরা অংশ নেয়। কুইজ বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।

1

এ বছর প্রথমবারের মতো প্রবর্তিত হয়েছে ‘সহজপাঠ ফাউন্ডেশন সম্মাননা’। সমাজসেবায় বিশেষ অবদানের জন্য বিশিষ্ট সমাজসেবক মামুন বিশ্বাস এবং উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিতপ্রাণ আসাদুজ্জামান রুবেলকে এই সম্মাননা প্রদান করা হয়।

উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ছিল সহজপাঠ ফাউন্ডেশনের বার্ষিক ম্যাগাজিন ‘সহজকথন’-এর মোড়ক উন্মোচন। মো. আশিকুর রহমানের সম্পাদনায় প্রকাশিত এই ম্যাগাজিনে দেশের প্রথিতযশা প্রাবন্ধিক ও কবিদের লেখা স্থান পেয়েছে।

মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে সম্পাদক মো. আশিকুর রহমান বলেন, আমরা চেয়েছি গ্রাম পর্যায়ের এই আয়োজনকে মেধা ও মননের জায়গায় নিয়ে যেতে। সহজকথন ম্যাগাজিনটি সেই চেষ্টারই একটি অংশ। এতে আমরা সমসাময়িক চিন্তা ও সাহিত্যের মেলবন্ধন ঘটানোর চেষ্টা করেছি। গুণী লেখকদের লেখা এই সংখ্যাটিকে সমৃদ্ধ করেছে। আশা করি পাঠক এটি পছন্দ করবেন।

উৎসবের বিশেষ আকর্ষণ ছিল আতিউর রহমানের নির্মিত ডকুমেন্টারি ফিল্ম ‘বইয়ের ফেরিওয়ালা’র প্রদর্শনী। আতিফ আসাদের বই নিয়ে সংগ্রামের গল্প নিয়ে এটি নির্মিত হয়েছে।

নির্মাতা আতিউর রহমান বলেন, এক তরুণ সাইকেলে করে বাড়ি বাড়ি বই পৌঁছে দিচ্ছেন—এই দৃশ্যটি আমাকে আলোড়িত করে। আতিফের এই লড়াইকে আমি পর্দায় তুলে আনার চেষ্টা করেছি। আমি চাই এই কাজের কথা সবাই জানুক। সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনগুলো মানুষের সামনে আসা জরুরি।

অনুষ্ঠানে সামগ্রিক আয়োজন নিয়ে সরিষাবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মো. রবিউল ইসলাম বলেন, সুস্থ সমাজ গড়তে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বিকল্প নেই। সহজপাঠ ফাউন্ডেশন তরুণদের বিপথগামিতা থেকে রক্ষা করতে কাজ করছে।

Capture

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহকারী পরিচালক (সংস্থাপন) মো. আরজু পারভেজ বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে শিল্প ও সাহিত্যের এমন চর্চা আশাপ্রদ। এটি জাতীয় সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করবে।

সহজপাঠ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা আতিফ আসাদ বলেন, এই উৎসব কেবল আনন্দ উদযাপনের জন্য নয়, বরং আমাদের হারানো ঐতিহ্য এবং বইয়ের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলার একটি প্ল্যাটফর্ম। আমরা চাই, প্রতিটি গ্রাম একটি করে পাঠাগার গড়ে উঠুক। আজকের এই সফল আয়োজন আমাদের সেই স্বপ্ন পূরণে সাহস জোগাচ্ছে। আগামীতে আমরা আরও বড় পরিসরে শিক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে চাই। এই আলোর মিছিলে আমি তরুণ প্রজন্মসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানাই।

সহজপাঠ ফাউন্ডেশন সম্পর্কে: ২০১৮ সালে ইন্টারমিডিয়েট শ্রেণিতে অধ্যয়নরত তরুণ আতিফ আসাদ মাত্র ২০টি বই নিয়ে ‘মিলন স্মৃতি পাঠাগার’ নামে এই যাত্রার সূচনা করেন। শুরুতে তিনি নিজে সাইকেল চালিয়ে পাঠকদের হাতে হাতে বই পৌঁছে দিতেন। বর্তমানে এই সংগ্রহ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় আট হাজার বইয়ে। আতিফ জামালপুরের সরিষাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় আঠারোটিরও বেশি পাঠাগার গড়ে তুলেছেন। বই পড়ানোর পাশাপাশি এই কার্যক্রম এখন শীতবস্ত্র বিতরণ, বন্যাদুর্গতদের সহায়তা, বৃক্ষরোপণ ও কুইজ প্রতিযোগিতার মতো মানবিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বিস্তৃত হয়েছে। আতিফ আসাদের এই ব্যক্তিগত উদ্যোগই এখন ‘সহজপাঠ ফাউন্ডেশন’ নামে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে।

সহজপাঠ ফাউন্ডেশনের মূল লক্ষ্য হলো গ্রাম ও শহরে পাঠাগার বিস্তারের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে পাঠাভ্যাস ও নৈতিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলা। প্রতিষ্ঠানটি জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) বাস্তবায়নে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও মানবিক কার্যক্রমে অবদান রাখতে অঙ্গীকারবদ্ধ। ভবিষ্যতে ডিজিটাল পাঠাগার, ই-লাইব্রেরি এবং অনলাইন পাঠক সেবা চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা আতিফ আসাদের মতে, মানবিকতা ও সচেতনতার মাধ্যমে একটি আলোকিত সমাজ গড়ে তোলাই সহজপাঠ ফাউন্ডেশনের মূল লক্ষ্য, যেখানে জ্ঞান হবে সবার জন্য উন্মুক্ত ও সহজলভ্য।

প্রতিনিধি/টিবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর