সমাজে প্রচলিত প্রবাদ আছে ‘ভাই বড় ধন, রক্তের বাঁধন’। কিন্তু বাস্তবে এই বন্ধন যে কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে, তার এক নির্মম উদাহরণ মিলেছে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার আদিয়াবাদ ইউনিয়নের সিরাজনগর নয়াচর উত্তরপাড়া গ্রামে।
সরেজমিনে জানা যায়, ওই গ্রামের মৃত কেরামত আলীর ছেলে মো. কামরুজ্জামান কামাল তার স্ত্রীর কুমন্ত্রণায় নিজের সহোদর প্রতিবন্ধী বোন কামরুন্নাহার (৩৫) এবং বড় বোন তাছলিমা বেগমের চলাচলের একমাত্র পথ বন্ধ করে দিয়েছেন। বসতঘরের পাশ দিয়ে দেয়াল তুলে দেওয়ায় প্রায় এক বছর ধরে দুই বোন কার্যত গৃহবন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
বিজ্ঞাপন
প্রতিবন্ধী কামরুন্নাহার জন্মের এক বছর পরেই পোলিওতে আক্রান্ত হয়ে দুই পা হারান। চলাফেরা করতে হয় হামাগুড়ি দিয়ে। তার বড় বোন তাছলিমা বেগমকে এখন ১০ ফুট উঁচু দেয়াল মই দিয়ে টপকে বাইরে বের হতে হয়। দুর্গম এই দেয়াল টপকানো অসম্ভব হওয়ায় পঙ্গু কামরুন্নাহার দীর্ঘ এক বছর ধরে ঘর থেকেই বের হতে পারছেন না।
কামরুন্নাহার জানান, মৃত্যুর আগে তাদের বাবা দুই বোনের নামে দেড় শতাংশ জমি লিখে দিয়ে যান। সেই জমিই এখন তাদের জীবনে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজের উপার্জনের জন্য কামরুন্নাহার সেলাইয়ের কাজ করতেন। কিন্তু যাতায়াতের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গ্রাহকরা আর তার কাছে আসতে পারছেন না। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে তার আয়ের একমাত্র পথ।
অভিযোগ ও পারিবারিক কলহ: অভিযোগ রয়েছে, ওই দেড় শতাংশ জমি ভাইয়ের নামে লিখে দিতে রাজি না হওয়ায় কামরুজ্জামান কামাল দুই বোনের ওপর নিয়মিত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালাতেন। এ বিষয়ে রায়পুরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানায় লিখিত অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার মেলেনি। স্থানীয় সালিশ-বৈঠকও কোনো কাজে আসেনি।
বড় বোন তাছলিমা বেগম বলেন, ‘আমরা এক ভাই ও পাঁচ বোন। সংসারের হাল ধরতে আমি বিয়ে করিনি। নিজেদের সম্পত্তি বিক্রি করে ভাইকে বিদেশ পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু দীর্ঘ ১৪ বছর প্রবাসে থাকলেও তিনি পরিবারের জন্য কোনো অর্থ পাঠাননি। দেশে ফিরে বিয়ে করার পর থেকেই শুরু হয় অশান্তি। জমি লিখে না দিলে আমাদের হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার ভয় দেখানো হচ্ছে।’
বিজ্ঞাপন
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য: স্থানীয় ইউপি সদস্য গাজী মাজহারুল ইসলাম পলাশ ঘটনাটিকে অত্যন্ত অমানবিক উল্লেখ করে বলেন, ‘চেয়ারম্যানসহ আমরা একাধিকবার মীমাংসার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সমাধান হয়নি। প্রশাসনের সরাসরি হস্তক্ষেপ ছাড়া এই দুই বোনের মুক্তি সম্ভব নয়।’
অভিযোগ অস্বীকার করে কামরুজ্জামান কামাল দাবি করেন, তার বোনরা তার জায়গায় ঘর তুলেছেন এবং এ বিষয়ে আদালতে মামলা চলছে। তিনি বোনকে ভরণপোষণের প্রস্তাব দিলেও তারা রাজি হননি বলে দাবি করেন।
রায়পুরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাসুদ রানা বলেন, ‘কারো চলাচলের রাস্তা বন্ধ করার অধিকার কারো নেই। তবে বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন থাকায় প্রশাসনিকভাবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ সীমিত। আমরা সমাধানের প্রস্তাব দিলেও কোনো পক্ষই তা মানছে না।’
এদিকে স্থানীয় এলাকাবাসীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। সবার মনে একই প্রশ্ন কোন ক্ষমতার বলে একজন ভাই তার প্রতিবন্ধী বোনকে এভাবে গৃহবন্দি করে রাখতে পারে? অসহায় এই দুই বোনের এখন একটাই আকুতি, কবে মুক্ত হবে তাদের চলাচলের পথ এবং কবে ফিরবে স্বাভাবিক জীবন?
প্রতিনিধি/একেবি

